বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:১০ পূর্বাহ্ন
বিনা পারিশ্রমে ৩১ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে রশিদ মাস্টারের পাঠশালা।পাঠশালাটির প্রতিষ্ঠাতা মো.আবদুর রশিদ। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রত্যান্ত অঞ্চল মনাকষা ইউনিয়নের তারাপুর দাড়িপাড়ার ইদ্রিশ আলীর ছেলে। ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর স্কুলে প্রায় ছয় হাজার শিশু ও বৃদ্ধ শিক্ষা নিয়েছেন। তাঁরা এখন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তবে সরকারি এমপিওভুক্তির জন্য কোনদিন আবেদন করেন নি তিনি। সম্প্রতি রশিদ মাস্টারের পাঠশালায় গিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।
আবদুর রশিদ মাষ্টার জানান, সাহাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন ‘মনাকষা হুমায়ন রেজা স্কুল’ এ। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাশ করেন। এর পর বাবা এবং ভাই অসুস্থ থাকায় বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। চার বছর বিরতি দিয়ে আবারও ভর্তি হন ‘আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজে। সেখান হতে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পাশ করেন। পরিবার দরিদ্রতার কারনে তখনই শেষ করতে হয় শিক্ষা জীবন।
নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করে চাঁনতারা প্রাইমারি স্কুল। সেখানে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর ষড়যন্ত করে বাদ দেয়া হয় স্কুল থেকে। সেখান থেকে মনোহরপুর এলাকায় চলে যান কৃষি কাজের সন্ধানে। পরে কৃষি কাজে মন না বসলে কিছুদিন পরে পাঁচজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে আবারও প্রতিষ্ঠিত করেন মনোহরপুর প্রাইমারি স্কুল। সেখানে স্কুলটি দ্রুত পরিচিতি লাভ করে এবং শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শুরু করেন। তখন আবারও একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে স্কুল হতে বিতাড়িত করেন।
এরপর ভেঙে পড়ে আবদুর রশিদ ও তাঁর পরিবার। ছেলে শিক্ষকতা করতে না পারায় হতাশ হয়ে পড়েন মা উমেতুন্নেশা। ১৯৯১ সালে মাকে শান্তনা দিতে নিজ বাড়ীর পেছনে বাঁশ বাগানে শুরু করেন শিক্ষকতা। খোলা জায়গায় সোপ-পাটি পেড়ে শুরু করা হয় স্কুল। প্রথমে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পড়ানো হত। তারপরে প্রাইভেটের মত করে অন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। এখন রাতে ও সকাল সন্ধ্যা পড়ানো হয় শিশু ও বয়স্কদের। সব মিলিয়ে এখন তাঁর পাঠশালায় শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় দেড়শ। সেখানে তাঁর ছেলে হোসেন আলী সম্রাট ও অবসরপ্রাপ্ত সাবেক স্কুল শিক্ষক শ্রী সবিন্দ্র নাথ দাস মাঝে মধ্যে পাঠদান করেন।আবদুর রশিদ আরও জানান, প্রথমে বাড়ীর পেছনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করলেও এখন তিনি বাড়ীর বাইরে দুটি টিন দিয়ে ঘর করে স্কুল পরিচালনা করছেন।তিনি বলেন, তাঁর শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহাপাড়া বাজারে একটি ওষুধের দোকান রয়েছে।
সে দোকান থেকেই মূলত তাঁর সংসার চলে। বর্তমানে তাঁর রয়েছে আট ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁরা সবাই বিভিন্ন পেশায় জড়িতআবদুর রশিদের স্কুলের বৃদ্ধ শিক্ষক শ্রী সবিন্দ্র নাথ দাস জানান, আদুর রশিদ মাস্টার বিনা পারিশ্রমিকে ৩১ বছর ধরে শিক্ষকতা করে আসছেন। সমাজে এটি বিরল। শরীর সুস্থ্য থাকলে তাঁকে সাহায্য করতে স্কুলে গিয়ে শিশুদের পড়ায়। এতে আমারও ভাল লাগে।স্থানীয় মামনি কেজি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সাথী খাতুন জানান,শিশু থেকে রশিদ মাস্টারের পাঠশালায় পড়েছেন। তারা এক সঙ্গে ২০-২৫ জন পড়তে আসেন। সেখানে বাংলা, ইংরেজি ও অংক পড়ানো হয়।তারাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানিসা খাতুন জানান,স্কুলের শিক্ষকরা বাড়ীর জন্য যে পড়া দেন,প্রতিদিন রশিদ স্যারের স্কুলে গিয়ে পড়ে আসি।
সেখানে কোন টাকা পয়সা লাগে না। পড়তেও ভালো লাগে।স্থানীয় বাসিন্দা নারগিস খাতুন জানান, তাঁর ছয় বছর বয়সী ছেলে আবদুর রহিম কে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করেছেন। তাঁর বড় ছেলে আবদুর রহমানকে রশিদ মাস্টারের পাঠশালায় পড়িয়ে স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেছেন। তিনি জানান,শিশুদের বাবা-মায়ের মত যত্ন করে পড়ানো হয় এখানে।সাহাপাড়া বাজারের ফলের দোকানদার সৈয়ব আলী জানান, তাঁর পরিবারে কেউ কেউ শিক্ষিত ছিল না। কেউ তাঁকে পড়া-শোনার জন্য বলেনি। নিজে স্বাক্ষরও করতে পারতেন না। দোকান দেয়ার পর হিসাবের জন্য লোক রাখতে হত। পরে রশিদ মাস্টারের পাঠশালায় গিয়ে রাতে ক্লাশ করে নিজে চলার সমান শিখেছেন। বেতন দিয়ে এখন আর লোক রাখতে হয় না।আবদুল খালেক নামে অপর মুদি দোকানি বলেন, পড়াশোনা না জানায় দোকান চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হত। কাষ্টমাররা বাকি খেয়ে টাকা দি না। নিজে লিখেও রাখতে পারত না। ফলে বাধ্য হয়ে রশিদ মাস্টারের পাঠশালায় ভর্তি হন। সেখানে বছরখানেক পড়াশোনর পর এখন তিনি নিজেই সব হিসেব লিখতে পারেন। এমনকি নিজ সন্তানদেরও তিনি বাড়ীতে পারেন।
শিবগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল কুমার ঘোষ জানান, রশিদ মাস্টারের বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না। তিনি বলেন, খোঁজ খবর নিয়েছেন তিনি। রশিদ একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এলাকার গরীব অসহায় শিশু, কিশোর এবং বয়স্করা তাঁর স্কুলের ছাত্র। তিনি তাকে আশ্বাস দিয়েছেন সার্বিক সহযোগীতা করবেন।শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবুল হায়াতকে একাধিকবার কল দিয়েও তিনি রিসিভ করেননি।