শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : অনেকটাই স্বাভাবিক নিয়মেই চলছে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। কিন্তু সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা বা সদস্যদের যথাসময়ে হচ্ছে না পদোন্নতি। এ নিয়ে প্রতিনিয়তই মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে বিসিএস পুলিশ ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের মধ্যে। দীর্ঘদিনেও পদোন্নতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা।
তাদের দাবি, সরকার পদোন্নতি জটিলতা নিরসনে পুলিশ সুপার (এসপি) ও উপ-মহাপরিদর্শকদের (ডিআইজি) জন্য সুপার নিউমারি পদের ব্যবস্থা করছে, কিন্তু সেখানে সেই সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) ও সাব-ইন্সপেক্টর বা সার্জেন্টরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বর্তমানে প্রায় ১৫০০ সাব- ইন্সপেক্টর পিএল ভুক্ত থাকার পরও ইন্সপেক্টর হতে পারছে না। পাশাপাশি আরও ১৫০০ এর বেশি ইন্সপেক্টরশীপ পাশ করে ট্রেনিং করে বসে আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ধরনের জটলা অতীতে পড়েনি। এখন অধিকাংশ ই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হইতে পড়াশোনা শেষ করে সাব- ইন্সপেক্টর এ চাকরি শুরু করে। কিন্তু তারা যথাসময়ে প্রমোশন পায় না।তাদের মনের মধ্যে অসন্তুষ থাকলেও সিনিয়রদের ভয়ে বলতে পারছে না। চাকরির বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও ভাগ্যে মিলছে না পদোন্নতি। অনেকে যে পদে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন, সেই পদেই অবসরে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের মধ্যে পারস্পরিক ক্ষোভ বাড়ছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, পরিদর্শক পদ জটিলতা নিরসনের জন্য সরকার চাইলে পদ সৃষ্টি করে পরিদর্শকদের জন্য পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে নতুন পদ সৃষ্টি করে অনেকটা পদোন্নতি নিরসন করেছি।
এখনও সরকার চাইলে ক্যাডারদের মতো নন-ক্যাডারদের সুবিধা দিতে পারে। যেমন সুপার নিউমারিতেও অপেক্ষমাণ পরিদর্শকদের পদোন্নতির আওতায় আনতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পরিদর্শক মাজহারুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, সম্প্রতি আমরা আইজি স্যারকে জানিয়েছি, যেন আমার দিকটাও তারা দেখেন। পুলিশ ক্যাডার থেকে ১৫ বছরে তারা চারটি পদোন্নতি নিচ্ছেন। আমাদের চাকরির মেয়াদ ৩০ বছর। এসআই পদেই ১৫ বছর পেরিয়ে যায়। এরপর পরিদর্শক পদ থেকে ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি পদোন্নতি হয় না। তিনি বলেন, সম্প্রতি পদ নিরসনের জন্য সুপার নিউমারির ব্যবস্থা করেছেন। আমাদেরও যেন কোটা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া হয়। আমাদের বেলায় যেন পদ বৈষম্য না হয় এটাই অনুরোধ।
পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা নবম গ্রেডের কর্মকর্তা। সরকারি অন্য চাকরিজীবীরা এই গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেলে তাদের গ্রেড পরিবর্তন হয়ে ষষ্ঠ হয়, অথচ আমাদের এএসপি পদে পদোন্নতি হলে গ্রেডের কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ এএসপিরাও নবম গ্রেডের কর্মকর্তা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা একই পদে ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় কর্মরত থাকলে তার গ্রেড পরিবর্তন হয়। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে সাধারণত তা হয় না। গ্রেড পরিবর্তন করতে হলে আবেদনের পাশাপাশি ব্যাপক তদবির করতে হয়। তারা জানান, পরিদর্শক থেকে এএসপি হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তাদের জন্য ৩৩ ভাগ কোটা থাকলেও গত তিন বছরে মাত্র ৩০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অমানবিক। তারা বলেন, প্রত্যেক সার্কুলারে সরাসরি এএসপি পদে ২০০-২৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিদর্শক থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি হয় ১ থেকে ২ শতাংশ।
বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, সম্প্রতি পুলিশ প্রধানের সঙ্গে বিশেষ কল্যাণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রস্তাব করা হয় পরিদর্শকরা নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পাওয়ার পরও নবম গ্রেডে থেকে যাচ্ছেন। অথচ বিধি অনুযায়ী পদোন্নতির পর তাদের ষষ্ঠ গ্রেডে যাওয়ার কথা। তখন আইজিপি আশ্বস্ত করেন পুলিশ সদর দফতরে অবেদন করতে। পরে ব্যবস্থা নেবেন।
বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তাদের একজন পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রউফ মন্ডল। সম্প্রতি পুলিশের আইজির (মহাপরিদর্শক) কাছে দেওয়া এক আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, গত বছর ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে বিশেষ কল্যাণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রস্তাব করি, পুলিশ পরিদর্শকরা নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পাওয়ার পরও নবম গ্রেডে থেকে যাচ্ছেন। অথচ বিধি অনুযায়ী পদোন্নতির পর তাদের ষষ্ঠ গ্রেডে যাওয়ার কথা। কল্যাণ শাখার সভাপতি বিভিন্ন অফিসের কাগজপত্র সংগ্রহ করে পুলিশ সদর দপ্তরে অবেদন করতে বলেন।
আইজিপির কাছে দেওয়া আবেদনে আব্দুর রউফ মন্ডল বলেন, পুলিশ পরিদর্শক ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির পদ। ২০১২ সালে সরকার এটিকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে উন্নীত করে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত নন-ক্যাডার (নবম গ্রেড) কর্মকর্তারা ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে নবম গ্রেডের কর্মকর্তারা পদোন্নতির পরও নবম গ্রেডে থেকে যায়। উদাহরণ হিসাবে ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়রি ৩৫ পুলিশ পরিদর্শকের পদোন্নতির আবেদনে প্রজ্ঞাপন সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতিসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন তুলে ধরা হয়। বলা হয়, পুলিশ পরিদর্শকদের নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতি দেয়ার পর নবম গ্রেডে থেকে যাওয়ায় তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আর এতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তার তুলনায় পুলিশ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
পরিদর্শকরা জানান, এএসপি হিসেবে পদোন্নতি ৩৩ শতাংশ দেওয়ার কথা থাকলেও বিগত ৩ বছরে ৩০ জনের মতো এএসপি হয়েছেন পরিদর্শকরা। পক্ষান্তরে বিসিএস ক্যাডার নেওয়া হয়েছে বিগত ৩ বিসিএসএ ৫০০ জনের মতো। এএসপি থেকে ২৮৮ পদ নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে ডিআআইজি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ক্যাডার যারা তারা পাচ্ছেন কিন্তু পরিদর্শক থেকে এএসপি হচ্ছেন না। যার কারণে এসআই থেকে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি হচ্ছে না।
তারা বলছেন, গত ২/৩ বছর ধরে বিসিএস পুলিশ অফিসারদের জন্য ‘সুপারনিউমারারি পদ (সুপারনিউমারারি পদ হলো- সংখ্যাতিরিক্ত পদ) সৃষ্ঠি করে কর্মকর্তা একই পদে অধিষ্ঠিত এবং পদোন্নতির পরেও একই দায়িত্ব পালন করছেন তারা। তবে একই নিয়ম কেন পুলিশ ইন্সপেক্টরদের বেলায় করা হচ্ছে না?, অথচ মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন পুলিশ ইন্সপেক্টরগণ!
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ ইন্সপেক্টর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন জানিয়ে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা পুলিশ ইন্সপেক্টর, দেশ ও দেশের শান্তি রক্ষায় দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের অভিভাবক, পুলিশ ইন্সপেক্টরদের জন্য আপনি কিছু একটা করুন!
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (এরই মধ্যে মৌলভীবাজারের এসপি হিসেবে যোগদান করেছেন) মনজুর হোসেন বলেন, নিচের পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের বঞ্চিত থাকার বিষয়গুলো পুলিশ সদর দপ্তর অবগত আছে। এগুলো সমাধানের লক্ষ্যে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এসব সমস্যার সমাধান হবে বলে যে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আজো তা কেবল কথার মধ্যেই বন্দী আছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, আমরা নিচের পদে পদোন্নতির জন্য পুলিশ সদর দফতরে কয়েক বার সভা করেছি। আশা করছি এই বিষয়গুলো শিগগিরই সমাধান করা হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সময়ের আলোকে বলেন, পুলিশের নন-ক্যাডার কোনো পদ নেই। পুলিশ ক্যাডারে যারা পদোন্নতি পাচ্ছেন তারা নিয়মের মধ্যেই পাচ্ছেন। আমরা কাউকেই খাটো করে দেখছি না।
পদোন্নতিতে এসআই ও পরিদর্শকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আসলে এই অভিযোগ সঠিক না। এসআই ও পরিদর্শকরা যে নিয়মে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন তাদের সেভাবেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আমরা বসে সমস্যা থাকলে নিরসন করা হবে।