শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৬ অপরাহ্ন
সুরা ফীল। পবিত্র কোরআনের ১০৫তম সুরা। এর আয়াত সংখ্যা পাঁচ। এ সুরায়— ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহার বিশাল হস্তি-বাহিনী ধ্বংসের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। সুরায় উল্লেখিত ফিল অর্থ হাতী। এ সুরায় হস্তীবাহিনীর ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগেও ভক্তি-শ্রদ্ধার এবং গর্ব-মর্যাদার প্রধান কেন্দ্র মনে করা হতো কাবা ঘরকে। কিন্তু তৎকালীন খ্রিস্টানরা কাবার মর্যাদা ও স্বীকৃত মর্যাদা মেনে নিতে পারেনি।
বিশেষত আরবের আশেপাশের ক্ষমতাশালী রোমান খ্রিস্টানদের কাছে পবিত্র কাবা চক্ষুশূল হয়ে উঠে। এ সময় আফ্রিকা সাম্রাজ্যের নাজ্জাশি বাদশাহর অধীনে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছিলো আবরাহা বিন সবাহকে। কাবার জনপ্রিয়তা আবরাহা সহ্য করতে পারলো না। হাজীরা মক্কায় যেসব নজরানা ও উপঢৌকন নিয়ে আসতো সে তা গ্রাস করার লোভ সামলাতে না পারলো না। সে হাজীদের মক্কার কাবা থেকে ফেরাতে নিজের রাজ্যে কাবার মতোই দেখতে একটি ঘর নির্মাণে মনস্থির করলো।
চিন্তাভাবনা করে সে ইয়ামেনের ‘সানা’ নামক জায়গায় মর্মর পাথর দিয়ে বিভিন্ন রকমের কারুকার্য খচিত একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করলো। এবং ঘোষণা দিলো আগামীতে যেন মানুষেরা কাবার পরিবর্তে এই নব নির্মিত গির্জায় এসে ইবাদত, উপাসনা, হজ ও তাওয়াফ করে। কিন্তু প্রকৃত কাবার প্রেমিকরা তার এমন ঘোষণা ও কাবার এই অমর্যাদা-অবমাননা কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তার এই ঘোষণা সর্বত্র দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। কুরাইশরা রাগে ফেটে পড়ল। কথিত আছে, তাদের কেউ একজন এসে ওই জাঁকজমকপূর্ণ গির্জায় গোপনে ঢুকে পায়খানা করে যায়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরাইশদের একদল যুবক ওই গির্জায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়, যাতে গির্জা পুড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
আবরাহা যে উদ্দেশ্যে গির্জা নির্মাণ করেছিল, সেই উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যর্থ হয়। আরবদেরকে কোনভাবেই যখন আকৃষ্ট করা গেল না, সে ক্রুব্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে কাবা ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। প্রথমে সে আবিসিনিয়ার রাজার কাছ থেকে হাতি সংগ্রহ করে। অতঃপর তার সৈন্য বাহিনীকে পবিত্র কাবা আক্রমণের নির্দেশ দেয়। বর্ণিত আছে, ভোরবেলা আবরাহা বাহিনী কাবা ধ্বংসের জন্য অগ্রসর হয়। কোনো বর্ণনায় ২০ হাজার এবং কোনো বর্ণনায় ৬০ হাজার সেনার কথা এসেছে। ওই বাহিনীর সঙ্গে নাজ্জাশির পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশাল হস্তিবাহিনী পাঠানো হয়, যার নেতৃত্বে ছিল মাহমুদ নামের একটি হাতি।
হস্তিবাহিনীর সংখ্যা কেউ বলেছে একটি, কেউ বলেছে দুটি, আটটি বা ১২টি বা তারও বেশি। তবে মাহমুদ ছিল এদের নেতা। বাকিরা মাহমুদের অনুগামী। এদের নেওয়া হয়েছিল এ জন্য যে লোহার শিকলের এক প্রান্ত কাবার দেয়ালে বেঁধে অন্য প্রান্ত হাতির ঘাড়ে বাঁধা হবে। এরপর হাতিকে হাঁকিয়ে দেওয়া হবে, যাতে পুরো কাবাগৃহ একসঙ্গে উপড়ে পড়ে। আবরাহা যখন মক্কা অভিমুখে রওনা হওয়ার উদ্যোগ নিলো, হাতিকে মক্কার দিকে হাঁকাতে চেষ্টা করলো, তখন হাতি বসে পড়লো। তারপর শতচেষ্টা করেও হাতিকে মক্কামুখী করা যায়নি। অথচ ইয়েমেনমুখী করা হলেই হাতি দৌড় দেয়, মক্কামুখী করলেই বসে পড়ে।
অন্যান্য হাতিও তাদের প্রধান সেনাপতি মাহমুদের অনুসরণ করে। হস্তি চালকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওদেরকে কাবামুখী করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। এ সময় হঠাৎ মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রের দিক হতে সবুজ বর্ণের ঘাড় বিশিষ্ট একদল কৃষ্ণ বর্ণের পাখির আবির্ভাব ঘটল। ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে উড়ে আবরাহার সৈন্যদের উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তরকণা বর্ষণ করতে লাগল। পাখিগুলোর মুখে একটি এবং দুই পায়ে দুটি কঙ্কর ছিল, যা ডাল ও গমের মতো। এই কঙ্কর যার মাথায় পড়েছে, সে-ই ধ্বংস হয়েছে। কিছু আঘাতপ্রাপ্তকে মরতে দেখে বাকি সবাই দিগ্বিদিক ছুটে পালাতে শুরু করে।
ইবনু ইসহাক বলেন, আবরাহার বাহিনী মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত মরতে মরতে যায়। আবরাহা সানা শহরে পৌঁছে লোকদের কাছে আল্লাহর আজাবের ঘটনা বলার পর মৃত্যুবরণ করে। এ সময় তাঁর বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায়। (ইবনে কাসির ও তাফসিরে মুনির) আবরাহার এই হামলার সময় মক্কার অধিবাসীরা প্রাণভয়ে পাহাড়ে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ল এবং পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করল। সেনাদলের ওপর আল্লাহর আজাব অবতীর্ণ হলে তারা নিশ্চিন্তে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যায়। (সিরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩, ৫৬)
বেশির ভাগ সিরাত রচয়িতার অভিমত অনুযায়ী, এই ঘটনা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের ৫০ অথবা ৫৫ দিন আগে ঘটেছিল। সে সময় ছিল মহররম মাস। ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অথবা মার্চের শুরুতে এই ঘটনা ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাক তাঁর নবী এবং পবিত্র ঘর কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে এর ভূমিকাস্বরূপ এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।