Noman Group Advertisement

ইয়াবা-হেরোইনের স্বর্গরাজ্যে ময়মনসিংহ

রেজাউল করিম রেজা , ব্যুরো প্রধান, ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১২:১৫ এএম

ভাই আমার কাছেও আম (ফেন্সিডিল) আছে। লাগলে রিং (ফোন) দিয়েন’- উঠতি এক কিশোর তার পরিচিত এক তরুণকে উদ্দেশে করে এ কথা বলছিল। কিন্তু, খোলামেলা এ কথা শুনেই যেন ভয় পেয়ে গেলেন ওই তরুণ। না শোনার ভান করে ছুটে চললেন নিজের গন্তব্যস্থলে।ময়মনসিংহ নগরীর বলাশপুর এলাকায় গতকাল (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঘটনাটি ঘটে। এর দু’দিন আগে বলাশপুর এলাকায় বস্তিতে আকস্মিক হানা যৌথ বাহিনী । তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে হেরোইন সেবনরত তরুণরা পালিয়ে যান। কিন্তু, পুলিশ চলে যাওয়া মাত্রই আবারও সেখানে হেরোইন সেবনের উৎসব শুরু হয়।

শিক্ষানগরী ময়মনসিংহের মাদকের ভয়াবহতার সামান্য চিত্র এটি। শহর থেকে শুরু করে উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে পর্যন্ত গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। ময়মনসিংহ শহর ও শহরতলির অন্তত ২৫০ শতাধিক স্পট হয়ে উঠেছে মাদক বিকিকিনির স্বর্গরাজ্য। এসব স্পটে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা মূল্যের মাদক কেনাবেচা হচ্ছে ।

এ মাদক ব্যবসায় আশঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই মাদক বেচাকেনায় তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।  দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এ সব কিশোররা মাদক বহন করতে গিয়ে এক সময় নিজেরাই হয়ে পড়ছে মাদকাসক্ত। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক ব্যবসায় জড়িত চুনোপুটিদের অনেক সময় আটক করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন রাঘববোয়ালরা।

জানা গেছে, নগরীর পুরোহিতপাড়া, কৃষ্টপুর, কেওয়াটখালী, চামড়া গুদাম, রামকৃষ্ণ মিশন রোড, চরপাড়া, মাসকান্দা, সানকিপাড়া, রেল ক্রসিং, সেনবাড়ি, সানকিপাড়া শেষ মোড়, গোহাইলকান্দি মীর বাড়ি, মালগুদাম, বাকৃবি শেষ মোড়, চরকালিবাড়ি, পাটগুদাম ব্রীজ মোড়, কাঁচারিঘাট, টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড, শম্ভুগঞ্জ মধ্য ও পশ্চিম বাজার, সাহেবকাচারী, খাগডহরসহ ২৫০ শতাধিক স্পট মাদক (ইয়াবা) কেনাবেচা ও সেবনের চিহ্নিত পয়েন্ট। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাদক কারবারি জানান, প্রতিদিন ময়মনসিংহের বিভিন্ন রুটে মাদকের বিপুল পরিমাণ চালান প্রবেশ করছে। যেমন ভারতীয় সীমান্তবর্তী নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার পাঁচগাঁ, বড়ুয়াকোনা, গোবিন্দপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রকাশ্যে দিনরাত ২৪ ঘন্টায় হাজার হাজার চিনির বস্তা, মসলা কসমেটিক্স সহ বিভিন্ন প্রকার মাদক দ্রব্যাদি ডিজিপিও স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। 

কয়েকটি বর্ডার দিয়ে চিনির বস্তা দিয়ে ফেনসিডিলের সবচেয়ে বড় চালানগুলো আসছে ময়মনসিংহ শহরে ।এমন একটি ভিডিও সংরক্ষন আছে। এর সাথে জড়িত ১২ জন গডফাদার। এরা হলেন শারমিন সুলতানা, তপন,আজিজুল,ইকবাল হোসেন, কালা আলাল, সোহেল ও সুমন। তারা বেশিসময় একজন পুলিশের কর্মকর্তার অফিসে দেখা যায় ঘোরাঘুরি করতে। 

কলমাকান্দা ও হালুয়াঘাট ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করা ফেনসিডিল বিভিন্ন কৌশলে ট্রাক অথবা বাসযোগে পৌঁছে যাচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সূত্র মতে, ময়মনসিংহের মাদক স্পটগুলোর নিয়ন্ত্রণ করেন শতাধিক পুরনো ব্যবসায়ী। অনেকেই জামিনে এসে কৌশলে তদবির চালিয়ে করে যাচ্ছে। আবার অনেকেই পুলিশের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছে। তিন যুগ ধরে এসব প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য। তাদের সাম্রাজ্যে প্রতিদিনই নাম লেখাচ্ছে নতুন নতুন মাদক ব্যবসায়ী। এর মধ্যে পুরোহিতপাড়া এলাকায় নূরেসা’র ফেনসিডিল স্পট সবার কাছেই পরিচিত। ইয়াবা বেচাকেনায় শীর্ষে রয়েছেন ত্রিশালের ২৪ জন, তারা ১০ বছরে ৫/৬ টি করে বাড়ির মালিক ও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে নিউজ করলেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যান ও কিছু যুবক দিয়ে হুমকি দিয়ে থাকেন। 

তবে ইতিমধ্যে ত্রিশাল থানার ওসি মনসুর আহমেদ অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। ওসি মনসুর আহমেদ জানান, মাদক কারবারীদের ধরতে আমার  টীম সব সময় অভিযান চালায়। কয়েকজন গডফাদার গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। শম্ভুগঞ্জ এলাকার ‘মল্লিকা’ খোলামেলা পরিবেশে চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের ব্যবসা। একাধিকবার গ্রেফতার হয়েও শহরের সেনবাড়ি ও সানকিপাড়া রেলক্রসিং এলাকায় চুটিয়ে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। মাদক বেচার জন্য তার বেতনভুক্ত কর্মীও রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, শহরের সবচেয়ে বড় ফেনসিডিল স্পট হিসেবে পরিচিত শহরের পুরোহিতপাড়া এলাকার একজন নারীর নাম।

সূত্র জানায়, নূরেসা এক সময় এক গ্রুপের হয়ে কাজ করলেও এখন পুলিশের একটি মহলকে হাত করে নিজেই এ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। ত্রিশালের বিএনপির  নেতা হাসমত রহমান বলেন, ত্রিশালে মাদকের ভয়াবহতা সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। সর্বনাশা মাদকের ছোঁয়ায় তিলে তিলে ক্ষয় হচ্ছে জীবন। অনেকেই পা বাড়াচ্ছে অন্ধকার গলির দিকে। মাদকের শেকড় উপড়ে ফেলতে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ময়মনসিংহে মাদকসেবীর সঠিক কোন হিসাব নেই। তবে ২০১১ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীপ মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, শহরের ৩১টি ওয়ার্ডে মাদকাসক্ত ছিলেন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ। এর মধ্যে কিশোর প্রায় ১ হাজার ২শ, যুবক বয়সী প্রায় আড়াই হাজার ও বাকিরা বিভিন্ন বয়সের। এরপর পরবর্তী কয়েক বছরে মাদকসেবীর সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। ময়মনসিংহে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা কত এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি জেলা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও। তবে বিভিন্ন সময় কয়েকজন গডফাদার মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর ও পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন।

ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম জানান, ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ জেলা প্রত্যেকটি অঞ্চলে মাদকের অভিযান চলছে। মাদক কারবারি থেকে শুরু করে সব অপরাধীদের গ্রেফতারের অভিযান যৌথভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। প্রত্যেকদিন অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে। যারা মাদক ব্যবসা করবে তাদের কোন রেহাই নাই।

Link copied!
Advertisement