অনুসন্ধানীর প্রতিবেদন - ১
জাহাঙ্গীর আলম তপু: আওয়ামী লীগের আমলে ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের বিভিন্ন থানায় ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসাবে পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তারা ছিলেন প্রভাবশালী পুলিশ পরিদর্শক। এসব কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই বিদায়ি সরকারের বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পাওয়া অথবা আওয়ামী পরিবারের সন্তান। কেউ কেউ এমপি- মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন।
তারাই ঘুরেফিরে ৫ থেকে ৮ বছর ধরে থেকেছেন ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের বিভিন্ন থানায়। এসব কর্মকর্তাদের যোগ্যতার মূল মাপকাঠি ছিল আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলেন তারা। প্রভাবশালী অনেক ওসিই তাদের সুপারভিশন অফিসারদের এএসপি/এডিশনাল এসপিদের পাত্তা দিতেন না। এসব ওসির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তৎকালীন সময়ে কারো কারো বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ হলেও তদবিরের কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষও তাদের কাছে জিম্মি ছিলেন। তারা একাধিক থানায় ওসি হিসাবে কর্মরত থেকে ময়মনসিংহ শহরের ফ্ল্যাট ও বিঘা বিঘা জমি কিনেছেন। কেউ কেউ আলিশান বাড়ি নির্মান করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
অনেকেই দুদকের ভয়ে স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের নামে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে রেখেছেন শত শত কোটি টাকা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ও পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, পুরোনো ধারা বদলে নতুন করে ঢেলে সাজানো হবে পুলিশ বাহিনীকে। এরই অংশ হিসাবে ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৩৬ থানার সব ওসি বদলি করা হয়েছে। সবকটি থানায় নতুন করে ওসি পদায়ন করা হয়েছে। তবে এবারও অভিযোগ উঠেছে, ময়মনসিংহে ওসি পদায়নে রাজনৈতিক মতাদর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যেমন কেন্দ্রীয় আ,লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেনের ভাতিজি জামাতা গাজীপুরের বাসিন্দা পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুল হাসান। তিনি আওয়ামী লীগের আমলে হালুয়াঘাট,গৌরীপুর,মুক্তাগাছা ও সর্বশেষ জামালপুরের মাদারগঞ্জ থানায় ওসি হিসাবে কর্মরত ছিলেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে জমা দেওয়া এক অভিযোগ থেকে জানাযায় , মির্জা আজমের নির্বাচনী এলাকা মাদারগঞ্জ,মুক্তাগাছা, হালুয়াঘাট ও গৌরীপুর থানায় বিএনপি-জামাত নেতা-কর্মীদের গায়েবী মামলা দিয়ে হয়রানি করা সেই ওসি মাহমুদুল হাসান বানিয়ে নিয়েছেন দুর্গাপুর থানার ওসির চেয়ার । সেই গায়েবী মামলা দেওয়া পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদুল হাসান কে সর্বশেষ নেত্রকোনা দুর্গাপুর থানায় গত (১১ ই মার্চ) পদায়ন করা হয়। এরপর থেকেই নেতা-কর্মীদের মাঝে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই প্রতিবেদককে বলেন, টাকা হলে ওসি হওয়া সহজ। তার বেলায় তাই হয়েছে।
নতুন করে পদায়ন পাওয়া বেশিরভাগ ওসিই বিগত বিএনপি সরকারের আমলে চাকরি পান। অবশিষ্টদের অধিকাংশ চাকরিতে নিয়োগের প্রাথমিক প্রক্রিয়া বিএনপি আমলে শুরু হয়, যোগদান করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তবে নিয়োগ পাওয়া এসব ওসিরা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বঞ্চিত ছিলেন। হয়েছেন নানা রকম হয়রানির শিকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ বাহিনীতে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি। তারা আগের মতোই দলীয় চিন্তা থেকে না সরলে সাধারণ মানুষের পুলিশি সেবা পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হবে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে পুলিশের এক পরিদর্শক প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, ময়মনসিংহে ওসি পদায়নে কখনোই কর্মদক্ষতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যে টাকা বেশি দিবে তার ক্ষেত্রেই সহজ হয়। অনেকেই বৈষম্য শিকার হলেও টাকার অভাবে ওসির চেয়ারে বসার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। মুক্তাগাছা ওসি কামাল হোসেন জানান, মাহমুদুল হাসান ৪ থানার ওসি ছিলেন। তাকে কিভাবে দুর্গাপুর থানার ওসি হিসেবে পদায়ন করলেন? সাংবাদিক সাহেব কি আর বলবো। আপনারা তো বক্তব্য নেন নিউজ করেন না? আপনাদের বলে লাভ কি? আমার থানায় আওয়ামী লীগের সময় দাপটি ওসি ছিলেন তিনি। মাহমুদুল কি করেছেন ভাল করে অনুসন্ধান করুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।
বিএনপি নেতা শাহীনুর আলম জানান, আওয়ামী লীগের আমলে ৪ টি থানায় কর্মরত থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার-নির্যাতনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ওসি মাহমুদুল হাসান। ফলে ৪ টি থানার সাধারণ মানুষও তার প্রতি ক্ষুব্ধ। ডিআইজি সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন এখন কিভাবে তিনি ওসি হলেন? আশ্চর্য বিষয়।
আইজিপি বরাবরে অভিযোগ করেছেন আমিনুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তার কাছে জানতে চাইলে, তিনি বলেন আমার অপরাধ ছিল বিএনপির করা। আমার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা দিয়েছেন তিনি। সবগুলো গায়েবী মামলা। তার মিথ্যা মামলা কারণে আজ আমার পড়াশোনা শেষ। আমার মত অসহায় আর কেউ নেই। আমার জীবনটাই শেষ করে দিয়েছেন তিনি। দুর্গাপুর থানার নয়া ওসি মোঃ মাহমুদুল হাসান জানান, মিজা আজমের রাজনীতি দ্বন্দ্বে আমাকে জামালপুরে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করেন। পরবর্তীতে অনেক কষ্টের পর দুর্গাপুর থানায় ওসি হিসেবে যোগদান করি। তথ্যগুলো সত্য নয়।
নেত্রকোনা পুলিশ সুপার মির্জা সায়েম মাহমুদ পিপিএম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, আমরা তদন্ত করে জানতে পারি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাহমুদুল হাসান ওসি ছিল না । তবে আওয়ামী লীগের সময় ময়মনসিংহের তিনটি ও জামালপুরে মাদারগঞ্জ থানায় ওসি ছিলেন।
আপনার মতামত লিখুন :