Noman Group Advertisement

শুক্রবার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসছেন জাতিসংঘ মহাসচিব

মাহবুব আলম মিনার , কক্সবাজার দক্ষিণ

প্রকাশিত: ১৩ মার্চ, ২০২৫, ০৩:০১ পিএম

ফাইল ছবি

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ৪ দিনের এক সফরে বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে তিনি এই সফর করছেন। মূল এজেন্ডা রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সাহায্য কমে যাওয়া, সেপ্টেম্বরে ঢাকায় রোহিঙ্গাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান মামলা, রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত জাতিগত নিধন ও গণহত্যার বিচার এবং প্রত্যাবাসনের মতো ইস্যু এই সফরকালে প্রাধান্য পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি পবিত্র রমজান মাসে মুসলমানদের মতো রোজা পালন করবেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের সঙ্গে তিনি এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইফতার করবেন।

এদিকে কক্সবাজারের সচেতন মহলের মতে আরাকান আর্মি নামের মং বাগিদের নানা উস্কানীমূলক কর্মকাণ্ড যেমন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের দিকে গুলি করা, মটারসেল নিক্ষেপ করা, সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখা, নাফনদী থেকে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা পণ্যবাহী ট্রলার জিম্মি করে আটকে রাখা, এইসব থেকে পরিস্কার বুজা যায় আরাকান আর্মি নামের এই মং বিদ্রোহীরা যেকোন মুহূর্তে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আক্রান্ত করার পরিকল্পনায় ব্যস্ত । 

বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য এখন সেই  বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলছে । এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুধু অনিশ্চয়তার মধ্যেই পড়েনি বরং নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা দিন দিন বেড়েই চলেছে । একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জও। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর বাড়াতে হবে । মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে আরাকান আর্মি নামে যারা আরাকান দখলে নিচেছ তাদের আসল পরিচয়, তারা রাখাইন জনগণ গোষ্ঠী, ইতিহাস বলছে আরাকান স্টেইট দীর্ঘ ৫০০ শত বছরের বেশি সময় ধরে মুসলমানদের শাসন আমলে মুসলিম রাষ্ট্র আরাকান ছিল।

এক সময় ভিবিন্ন কৌশলে আরাকানের মুসলমানদের ক্ষমতার দখল নিয়ে নেয় মিয়ানমার সরকার। আরাকানে বসতবাড়ি মুসলিমনদের পাশাপাশি বুদ্ধ ধর্মালম্বী রাখাইন দের কে প্রতিষ্ঠা করতে মিয়ানমার সরকার  ভিবিন্ন দেশ থেকে ভাসা মং বা রাখাইনদের নিয়ে যায়। মুসলিমদের কাছ থেকে অধিকাংশ জায়গা কেড়ে নিয়ে রাখাইন দের বসতি স্থাপন করে। এক সময় প্রতিটি মুসলমানদের পাড়া মহল্লার আশেপাশে মং রাখাইনদের পাড়া তৈরি করে দেয়। রাখাইনদের যাতায়াত সুবিধায় করে দেয় পাকা রাস্তা আর মুসলমানদের যাতায়াত পথ ক্ষত বিক্ষত করে না না কষ্টে রাখে মিয়ানমার। ভিবিন্ন চেষ্টায় আরাকানের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন নাম প্রতিষ্ঠা করারও চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মিয়ানমার। নানা সময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের কষ্ট দিতে রাখাইন মং বা ভাসা মংদের ব্যবহার করে মুসলিমদের ওপর নিপিড়ন নির্যাতন করে বার বার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য করে রোহিঙ্গাদের। রাখাইন মং বা মিয়ানমারের মিলিটারির নিপিড়ন নির্যাতন সহ করতে না পেরে ভিবিন্ন সময় বাংলাদেশে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা।

বিগত সময়ের ইতিহাস বলছে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কিছু অংশ মিয়ানমার ফেরত নিলেও টেকসই প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারে মুসলিমদের সেবজোন না থাকায় বার বার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। এরই  ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ১ লক্ষ্য রোহিঙ্গা কে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করে মিয়ানমার, একবছর পার হতে না হতে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও রাখাইন মং  আবারোও রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা গণহত্যা রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে অবশেষে ১২ লক্ষ্যের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করে।

যাদের এখনো ফিরিয়ে নেয়নি। এদিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন রোহিঙ্গা কে ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার।  প্রত্যাবাসনের কথা বলে নানা নাটকের মধ্য দিয়ে শেষ করে,এরই মধ্যে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির শুরু হয় তুমুল লড়াই। মূলত কৌশল হিসেবে আরাকান আর্মি নাম টি ব্যবহার করে তারা। প্রকৃতপক্ষে তার পরিচয় রাখাইন বা ভাসা মং তার অর্থ হল ভিবিন্ন রাষ্ট্র থেকে গিয়ে আরাকানে বসতি করায় তাদের ভাসা মং বলা হয়।

বিএনপির সাবেক এমপি বা জাতিয় সংসদের হুইপ উখিয়া টেকনাফের জনপ্রিয় নেতা শাহাজাহান চৌধুরী বলেন, রাখাইনে যুদ্ধ চলমান। এ অবস্থায় সীমান্ত রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সেখানে মিয়ানমারের সেনারা নেই, আছে আরাকান আর্মি। এটি বাংলাদেশের সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য এক অর্থে হুমকি দাড়াচ্ছে । এছাড়া সীমান্তে যখন এ ধরনের একটি গোষ্ঠী থাকে তখন তাদের মাধ্যমে দেশের মধ্যে থাকা অনেক উগ্রপন্থী সংগঠনের উৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আরাকান আর্মি আমাদের জন্য নিরাপত্তার চেয়ে কূটনৈতিক জটিলতাটি বাড়িয়েছে। কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। আমরা মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি হবে সেটা আমরা স্থির করতে পারিনি। কাজেই কূটনৈতিক সম্পর্কের জায়গাটিতে একটু গভীর বিচার বিশ্লেষণ করে নীতিনির্ধারণ করতে হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের জন্য আরাকান আর্মি নিরাপদ নয়। তারা একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারোও কথা পরোওয়া করেনা তারা। গেল দুই মাসে তারা বাংলাদেশের  নাফনদী থেকে ট্রলার, ফিশিং বোটসহ জেলেদের বার বার ধরে নিয়ে গেছে। আরাকান আর্মিদের গুলাগুলি বার বার নাফনদীতে এসে পড়ায় সেন্টমার্টিনের মত প্রবালদ্বীপে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ করতে হয়েছে। বিগত ১২ ফেব্রুয়ারীতে ২১ জন রোহিঙ্গা জেলে কে ধরে নিয়ে আটক রেখে এখনো ফেরত দেয়নি আরাকান আর্মি নামের এই বিদ্রোহীরা। বাংলাদেশের মত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের দিকে গুলি,মটারসেল,মাইন নিক্ষেপ করতে মোটেই পরোয়া করে না তারা। 

সম্প্রতি ব্যাংককে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ হারানো মিয়ানমার সরকারকে ‘সীমান্ত ও রাখাইন সমস্যা নিয়ে করণীয় নির্ধারণের’ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারকে বলেছি, তোমাদের সীমান্তে তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে ‘নন-স্টেট অ্যাক্টরের’ হাতে চলে গেছে। আমরা তো রাষ্ট্র হিসেবে ‘নন-স্টেট অ্যাক্টরের’ সঙ্গে আলোচনা করতে পারি না। প্রসঙ্গত, নন-স্টেট অ্যাক্টর হলো রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান সম্প্রতি এক বক্তৃতায় এ ধরনের যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অন্যদিকে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, আমাদের জাতীয় স্বার্থে যা করণীয় সেটাই আমরা করব। তার লক্ষ্য হবে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১২ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন।

তবে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। তারা বলছেন, এতে করে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। এজন্য তাদের পরামর্শ যদি আরাকান আর্মি দীর্ঘদিন ধরে এই রাজ্যের দখলে থাকে তাহলে বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে তুলতে পারে। জাতিসংঘ তখন প্রস্তাব তুলবে। এই দুই পক্ষের মধ্যে মাঝামাঝি তখন অবস্থান নেবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। তখন কিন্তু বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুযোগ তৈরি হতে পারে। তবে এখানে বাংলাদেশ কতটা কূটনৈতিক দূরদর্শিতার সঙ্গে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে সেটিই এখন দেখার বিষয়।  

বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের পাশাপাশি বসাবাসরত সচেতন মহলের দাবী  রাখাইন মং বা আরাকান আর্মি নামের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী নতুন নিপিড়ন নির্যাতনের মূখে ২০২৪ সালে আবারও ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

বিএনপির সাবেক উখিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ চৌধুরী বলেন,  রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন জরুরি, আরাকানে রোহিঙ্গাদের সেবজোন, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা  নিশ্চিত না করলে রোহিঙ্গাদের বার বার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য করবে মিয়ানমার বা আরাকান আর্মি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিষয় জানানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। 

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঝুঁকি এড়াতে নাফ নদীতে সব ধরনের নৌযান চলাচল সীমিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে অনুপ্রবেশ রোধ ও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় নাফ নদী ও স্থলসীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন।

Link copied!
Advertisement