কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৯-এ কর্মরত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম (IOM)-এর অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও ‘ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ’ (NGO Forum)-এর হাইজিন অফিসার নাদিয়া হাসানের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর নিয়োগ বাণিজ্য ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি হোস্ট কমিউনিটির অসহায় নারীদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিজনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে আদায় করেন, কিন্তু প্রতিশ্রুত চাকরি বাস্তবায়ন করেননি।
ভুক্তভোগী জুবাইদা আক্তার জানান, ডিসেম্বর মাসে নাদিয়াকে টাকা দেওয়ার পর তাদের দুজনকে তিন মাসের জন্য চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের ৫ মার্চ হঠাৎই ‘বাজেট সংকট’ দেখিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পুনঃনিয়োগের আশ্বাস দিয়ে দীর্ঘ সময় পার করা হলেও, কোনো অগ্রগতি হয়নি। এক পর্যায়ে যোগাযোগ করলেই নাদিয়া হাসান নানা অজুহাত দেখিয়ে ফোন কেটে দেন। পরে ফোন রিসিভ করাও বন্ধ করে দেন ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাদিয়া হাসান দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশ প্রজেক্টের অধীনে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ক্ষমতাধর যুবলীগ নেতা সাঈদুল ইসলামের ছত্রছায়ায় থেকে নিয়োগ বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি দরিদ্র নারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি না দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন। ভুক্তভোগীদের কেউ স্বামীহারা বিধবা, কেউ পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম। চাকরির আশায় কেউ ঋণ করেছেন, কেউবা বিক্রি করেছেন গয়না, গৃহস্থালী বা প্রাণিসম্পদ।
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী সালমা ইয়াসমিন সুমি গত ২০ মে উখিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আরিফ হোসেন অভিযোগ গ্রহণ করে এসআই সুমনকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাদিয়া হাসান দাবি করেন, তিনি অভিযোগকারীদের চিনেন না এবং বিষয়টি থানায় তদন্তাধীন। তার ভাষ্যমতে, সাবেক ম্যানেজার সাঈদুল ইসলামের মাধ্যমে নিয়োগ সংক্রান্ত সিভিগুলো তার কাছে এসেছিল এবং তিনি ওই নিয়োগের সাথে সরাসরি জড়িত নন। তিনি অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করবেন বলেও জানান।
তবে এই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের দাবি, বহুবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সুরাহা না পেয়ে এখন তিনি দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন এবং পুরো ঘটনা সাবেক ম্যানেজারের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে এনজিও ফোরামের হেড অফ প্রোগ্রাম তরিকুল ইসলাম জানান, "নাদিয়া হাসান আমাদের একজন হাইজিন অফিসার। তার বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ এখনো পাইনি। অভিযোগ পেলে এনজিও ফোরামের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি তা যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।"
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তরিকুল ইসলামের সঙ্গে নাদিয়া হাসানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে তার দুর্নীতি ও অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় অভিযোগ জানানো হলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। বরং অফিসে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেও 'বাজেট সংকট' দেখিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজারে এনজিও ফোরামের সেক্টর কো-অর্ডিনেটর মো. সোহাগ প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি গণমাধ্যমে না আনার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। থানার তদন্ত কর্মকর্তা এবং আমাদের অর্গানাইজেশনের লিগ্যাল টিম কাজ শুরু করেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একটি ব্যক্তির অপকর্মের দায় পুরো অর্গানাইজেশনের নয়।”
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রতারণার অভিযোগ আড়াল করতে জুবাইদা আক্তার ও হুমাইরা আক্তার নামে দুইজনকে সাময়িকভাবে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র তিন মাস পর ২০২৫ সালের ৫ মার্চ চাকরিচ্যুত করা হয়, যা পরবর্তীতে পুরো প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।
এ ঘটনায় উখিয়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সুমন জানান, “আমি বাদী-বিবাদী উভয়ের বক্তব্য নিচ্ছি। তদন্ত চলছে, দোষ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এনজিও ফোরামের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি উঠেছে— অবিলম্বে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
আপনার মতামত লিখুন :