ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত ও চাকরিচ্যুত হয়েও প্রভাবশালীদের রোষানল থেকে রক্ষা পাননি গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ডিআইজি ড. মো. নাজমুল করিম খান ও ময়মনসিংহের সাবেক ডিআইজি ড. আশরাফুর রহমান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় পদন্নোতি পাওয়া ২জন পুলিশ কর্মকর্তাকে ষড়যন্ত্র করে অন্যায়ভাবে আওয়ামী প্রভাবশালী ব্যক্তি ও একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারে থাকা কিছু কর্মকর্তার টার্গেটের শিকার হন তারা।
ময়মনসিংহের সাবেক ডিআইজি ড. আশরাফুর রহমানকে আ'লীগের প্রভাবশালীদের অর্থায়নে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও কথিত ব্যক্তিদের মব জাস্টিজ ও মানষিকভাবে হয়রানির শিকার হন তিনি।কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ময়মনসিংহ রেঞ্জ থেকে (গত ২৩ মার্চ ২৫:) পুলিশ হেডকোয়ার্টার বদলি করা হয় ডিআইজি ড.আশরাফুর রহমানকে।এমনটাই দাবী করেছেন ময়মনসিংহ এলাকার সচেতন মহল।
ডিআইজি ড.আশরাফুর রহমান বর্তমানে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ডিআইজি (ক্রাইম) হিসাবে কর্মরত আছেন।
ড.আশরাফুর রহমান ছাত্রজীবনে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও কর্মজীবনে পেশাদার, সৎ, যোগ্য ও সাহসী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের মেধাবী এই কর্মকর্তা।
গাজীপুরে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খানকে (১ সেপ্টেম্বর) পুলিশ সদর দপ্তরের এক আদেশে তাকে সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে বলা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোন আদেশ জারি হয়নি এখনো।
প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ কমিশনার ড.নাজমুল করিম খান কী এখনো জিএমপি কমিশনার হিসাবে আবারও ফিরে আসবেন?:
অনুসন্ধানে জানা যায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়। পরে ২৮ আগস্ট ২০২৪ সালে তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হন। ১২ নভেম্বর ২০২৪ সালে জিএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ড. মো. নাজমুল করিম খান। চলতি বছরের ১ মে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নাজমুল করিম আমাদের নেতা, মন্ত্রনালয়ের আদেশ ছাড়াই যদি উনাকে বসে থাকতে হয়, তাহলে আমাদের মত কর্মকর্তাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াবে?
অন্যদিকে ডিআইজি ড. আশরাফুর রহমান ২০০৮ সালে পটুয়াখালী জেলায় কর্মরত ছিলেন। পরে চট্টগ্রাম রেঞ্জে আরআরএফ-এর কমান্ডেন হিসাবে বদলি করা হয়।এর কিছু দিন পর শান্তিরক্ষা মিশনে ২০১০ সালে মেধাভিত্তিক তাকে পাঠানো হয়। শান্তি মিশন থেকে ২০১১ সালে ফিরে আসলে প্রায় বছরখানে পোস্টিং ছাড়া বসে থাকতে হয়। তারপর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি হিসাবে যোগদান করেন। সেখানে কোন দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি।
জানা যায়,ড. আশরাফুর রহমান ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে সেভেন আর্মস পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক হিসেবে বদলি করা হয়।২০১৭ সালের প্রথম দিকে ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার হিসাবে বদলি করা হয় ট্যুরিস্ট হেড কোয়ার্টারে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ট্যুরিস্ট পুলিশেই কর্মরত ছিলেন তিনি।
২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে ডিআইজি হিসাবে পদায়ন করে ময়মনসিংহ রেঞ্জে পাঠানো হয়।চারটি জেলার মধ্যে ময়মনসিংহ জেলাতেই মাত্র ৬ মাস দায়িত্ব পালন কালে ৬৮০ জন আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের গ্রেপ্তার করে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি।তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় নানাবিধ ষড়যন্ত্র।
অবশেষে ময়মনসিংহের শীর্ষ আ'লীগ নেতা ও প্রভাবশালী ফ্যাসিবাদের দোসরদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যোগ দিতে হয় তাকেও। অদ্যাবধি তাদের দুজনের নামে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পদধারী নেতারা গোপনে ও প্রকাশ্যে নামে- বেনামে অভিযোগ করে যাচ্ছেন। এই ফ্যাসিবাদরাই আবার বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও দপ্তরে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন।লেনদেন হচ্ছে মোটা অংকের টাকা দামী পছন্দের উপহার।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যদিও সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে গাজীপুরের পুলিশ কমিশনারকে ক্লোজ করেছে সদর দপ্তর, তবুও এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কমিশনার ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনাররা ঢাকার বাসায় থেকে অফিস করতেন। ড. নাজমুল করিম খানও সেই নিয়মেই যাতায়াত করেছেন। পূর্ববর্তী কমিশনার ও কর্মকর্তারাও একইভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এতদিন এ নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ হয়নি বা সদর দপ্তর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গাজীপুরের দূরত্ব ঢাকার সঙ্গে খুব বেশি নয়। তাহলে যোগদানের নয় মাস পর হঠাৎ বিষয়টি সামনে আসা তদন্তসাপেক্ষ।
সরকারি বাসা বরাদ্দ না থাকায় একজন পুলিশ কমিশনারের জন্য ব্যক্তিগতভাবে বাসা ভাড়া করে পরিবারসহ থাকার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি ছিল। কর্মকর্তারা আরও জানান, দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি মব বন্ধ করা, নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসন, বিশ্ব ইজতেমার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং গার্মেন্টস সেক্টরের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রভাবশালী একাধিক গ্রুপ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। এ কারণেই তাকে সরাতে নানা কৌশল নেয়া হয় এবং তার বক্তব্যসহ বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশের প্রেক্ষিতে তাকে ক্লোজ করা হয়েছে। এতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তারা আরও বলেন, দেশের সব মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের নিজস্ব সরকারি বাসভবন থাকলেও জিএমপি কমিশনারের জন্য কোনো আবাসন সুবিধা নেই। এ কারণে ঢাকায় থাকার বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরও সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছে।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর বিশ্ব ইজতেমা সফলভাবে সম্পন্ন করেন ড. নাজমুল করিম খান। তার নেতৃত্বে ছয় মাসে দুই হাজার ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার, হোটেলভিত্তিক অবৈধ ব্যবসা বন্ধ, জুয়া প্রতিরোধ, পোশাক খাতে অস্থিরতা মোকাবেলা, অবৈধ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেন। সম্প্রতি আলোচিত দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যা মামলায় তার নেতৃত্বে মাত্র তিন দিনের মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নয়জন হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে ৮জন কিলারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্র দাখিল করে সাংবাদিক সমাজে প্রসংশা কুড়িয়েছেন। পাশাপাশি দ্রুত অপরাধী আইনের আওতায় আসায় সাংবাদিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা ও স্বস্তি ফিরে আসে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, ড. নাজমুল করিম খান বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি জাপান থেকে কৃষিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। পুলিশের সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে বিশেষ পুলিশ সুপার থাকাকালীন ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে তৎকালীন সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। তবে আদালতের লড়াই ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে তিনি চাকরিতে ফিরে আসেন। পরে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ স্টাফ কলেজে যোগ দেন। সেখান থেকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ১৫ ব্যাচের ও ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় এবং ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় তাদের বদলি করা হয়।ফলে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল খুশিতে আত্মহারায় আনন্দিত ও খুশমেজাজে আছেন।
আপনার মতামত লিখুন :