বিশ্বব্যাংকের ৫,৩৮৯ কোটি টাকার প্রকল্পে হরিলুট

রেজাউল করিম রেজা , বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৭ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:১২ এএম

বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতে আধুনিকায়নের অন্যতম বৃহত্তম উদ্যোগ প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি), যা বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট বাজেট ৫,৩৮৯ কোটি ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এর লক্ষ্য ছিল দেশের দুগ্ধ ও পশুপালন খাতে বিপ্লব ঘটানো, আধুনিক কসাইখানা, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও উন্নত যন্ত্রপাতি স্থাপন করা। 

কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারা বলছে উল্টো কথা  এখানে নিয়ম-নীতি উপেক্ষা, দুর্নীতি ও পরিকল্পিত লুটপাটের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (সিটিসি) হিসেবে দায়িত্বে থাকা ডা. গোলাম রব্বানী এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কোটি কোটি টাকার ক্রয় কার্যক্রমে অন্যায় সুবিধা নিয়েছেন। সরকারের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)–২০০৮ অনুযায়ী ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ না করে প্রকল্পের দরপত্র ও প্যাকেজগুলো ভাগ করা হয়েছে এমনভাবে যাতে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের অনুমোদন এড়িয়ে যাওয়া যায় যা সরাসরি আর্থিক বিধি লঙ্ঘন ও দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।

২০২৪ সালের ৬ জুন চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকায় তিনটি কসাইখানা নির্মাণের জন্য প্যাকেজ নং এলডিডিপি/W-85, 86, 87–এর অধীনে দরপত্র আহ্বান করা হয়।

প্রতিটি কসাইখানার ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। মূল ডিপিপি অনুযায়ী মোট ব্যয় ছিল ২৪৯ কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত ডিপিপিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

অর্থাৎ, অতিরিক্ত ৪৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই, যা পরিকল্পিতভাবে দর বাড়ানোর ইঙ্গিত বহন করে।

প্রকল্পের অধীনে শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও মেশিনারি ক্রয় করা হলেও অনেক সরঞ্জাম এখনও প্যাকেটবন্দী বা অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। ঠিকাদারদের বিল সম্পূর্ণ পরিশোধ করা হলেও মাঠ পর্যায়ে যন্ত্রপাতিগুলোর কোনো কার্যকর ব্যবহার নেই।

সিনিয়র কর্মকর্তা ও ঠিকাদার সূত্রে জানা গেছে, ডা. গোলাম রব্বানী নিজে এসব ক্রয় কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে অনিয়মের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করে। অভিযোগ রয়েছে, একাধিকবার অনিয়মের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ জমা পড়লেও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই একই কর্মকর্তাদের, যারা অভিযুক্তদের সহযোগী ছিলেন।

ফলে তদন্ত প্রক্রিয়া কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে।

ডা. গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে পূর্ববর্তী ক্রয় কার্যক্রম— প্যাকেজ নং G-97, G-98, G-99 ও G-100–এ মোট ২৫৪ কোটি ৬৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার ক্রয় কার্যক্রমেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।

প্রকল্পের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “ডা. গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনো ফল হয় না। সচিব ও মন্ত্রীর কাছেও প্রমাণসহ অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”প্রকল্পের অধীনে নির্মিত অবকাঠামো ও স্থাপিত যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত ও অকেজো হয়ে পড়ায় কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় অর্থ বেহাত হচ্ছে।

ফলে সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এলডিডিপি এখন উন্নয়ন নয়, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও পরিকল্পিত লুটপাটের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটির সহায়ক সংস্থা হলেও কার্যকর মনিটরিং ও তদারকির ঘাটতি স্পষ্ট। সরকারি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উদাসীনতা ও নীরবতা প্রকল্পটিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের গভীর সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের এই অনিয়ম শুধু একটি প্রকল্পের ব্যর্থতা নয় — এটি বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

Advertisement

Link copied!