ডিজেল চুরিতে তেল টুটুলের সিন্ডিকেট

নিজস্ব সংবাদদাতা , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ০৯ নভেম্বর, ২০২৫, ১২:১৪ এএম

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অবস্থিত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডিপো থেকে বিপুল পরিমাণ ডিজেল চুরির এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। সরকারি হিসাবে, চুরি যাওয়া তেলের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার ১৬৮ লিটার। এই ঘটনায় যমুনা অয়েল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও—সেসব তদন্তকে ঘিরে উঠেছে ধামাচাপার আশঙ্কা।

অভিযোগ উঠেছে, এত বড় জালিয়াতির সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তারাই আবার তদন্ত কমিটির সদস্য। যমুনার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, “অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়।” তাঁদের মতে, দুদক, সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়া সত্য উদঘাটন সম্ভব নয়।

এদিকে চোরাই তেল সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে উঠে এসেছে জয়নাল আবেদিন টুটুল—যিনি স্থানীয়ভাবে “তেল টুটুল” নামে পরিচিত। তাঁকে রক্ষা করতে ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে কোটি টাকার “ম্যানেজমেন্ট মিশন”। যমুনা অয়েলের নথি অনুযায়ী, ফতুল্লা ডিপোতে তিনটি “গ্রেজার” পদ থাকলেও টুটুল একাই তিনটি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর নিয়ন্ত্রণে কাজ করে কয়েকজন ক্যাজুয়েল শ্রমিক, যারা তাঁর হয়ে তেলের পরিমাপ ও উত্তোলন নির্ধারণ করে।

স্থানীয় কর্মচারীদের ভাষায়—“ফতুল্লা ডিপো মানেই টুটুলের রাজত্ব।”

তেল টুটুলের বিরুদ্ধে রয়েছে তিনটি হত্যা মামলা। তিনি টানা ১৭ বছর ধরে ফতুল্লা ডিপোর “গডফাদার” হিসেবে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। ৪ অক্টোবর ২০২৫ (দুর্গাপূজার ছুটির দিনে) তিনি কালো গ্লাসের গাড়িতে ডিপোতে গিয়ে কর্মচারীদের হুমকি দেন, “উপরের মহল ম্যানেজ—কেউ মুখ খুলবে না।”

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে বহুদিন।

যমুনা অয়েলও ২৮ ও ৩০ সেপ্টেম্বর দুটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করে, কিন্তু কোনো রিপোর্টই সময়মতো জমা হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, বিপিসি তদন্ত দলও ডিপো পরিদর্শনে এসে স্থানীয় কর্মচারীদের সঙ্গে কথা না বলেই ফিরে গেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে।

তেল টুটুল ফেঁসে গেলে বিপাকে পড়তে পারেন বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এজিএম ডিপো অপারেশন শেখ জাহিদ আহমেদ, ডিপো ইনচার্জ আসলাম খান আবু উলায়ী, ক্যালিব্রেটর কর্মকর্তা নুরুল হক। যমুনা অয়েলের ভেতরের অনেকেই বলছেন, এই কর্মকর্তাদের ছত্রছায়াতেই এত বড় চুরির ঘটনা সম্ভব হয়েছে। নিজেদের বাঁচাতে তাঁরা এখন “ক্যালিব্রেশন ত্রুটি”কে দায়ী করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে তদন্তে নেমেছে। ৮ অক্টোবর দুপুর থেকে দুদকের সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান নেতৃত্বে যমুনা অয়েলের পতেঙ্গা টার্মিনালে অভিযান চালান।

সেখানে তেল সরবরাহ সংক্রান্ত নথি জব্দ করা হয়। পরে আগ্রাবাদ প্রধান কার্যালয় থেকেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য ও রেকর্ড নেওয়া হয়। দুদকের উপপরিচালক মো. সুবেল আহমেদ বলেন, “বিষয়টি কমিশনের নির্দেশে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে, কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।”

সরকারি অর্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার তেল চুরির ঘটনায় শুধু একজন “তেল টুটুল” নয় পর্দার আড়ালে আরও বড় সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে মনে করছে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এখন প্রশ্ন একটাই তদন্ত কি সত্যিই অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করবে, নাকি আরেকবার ধামাচাপা পড়বে কোটি টাকার তেল কেলেঙ্কারি?

Advertisement

Link copied!