২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর—গাজীপুরের পূবাইল। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ১০টা ছুঁইছুঁই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিএনপি নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হচ্ছিলেন মিরের বাজার এলাকায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পরিণত হয় সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম নৃশংস রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায়—যা আজও পূবাইল থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভুলতে পারেনি। সেদিনের সেই গুলির শব্দ, ছরার ঘায়ে চিৎকার আর রক্তাক্ত শরীরের দৃশ্য এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ১২ বছর পরেও ক্ষত শুকায়নি। বরং সময় যত গেছে, ব্যথার তীব্রতা তত গভীর হয়েছে।
ট্রাজেডির অন্যতম রক্তাক্ত আবুল হোসেন: যাকে বাঁচাতে গিয়ে হাসপাতাল থেকে মর্গের দরজা পর্যন্ত টানাটানি হয়েছিল:
পূবাইল থানা যুবদলের সদস্যসচিব আবুল হোসেন সেদিন মিছিলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, শত শত ছরার গুলি একসঙ্গে তার শরীরে এসে পড়ে। তার দুই পা, কোমর, হাত—একাধিক জায়গায় গভীর ক্ষত। পায়ে তিনটি গুলি সরাসরি ঢুকে বের হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া অবস্থায়ও তাকে ঘিরে থেকে ছরার গুলি চালানো হয়—এমন তথ্য জানিয়েছে ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। তাকে প্রথমে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান—রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন। গুলির আঘাত এত বেশি যে সঠিকভাবে ছরা বের করাও ঝুঁকিপূর্ণ। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। পুলিশ পাহারায় তিন মাস চিকিৎসা, এরপর তিন মাস কারাগারে—মোট ছয় মাস পর তিনি জামিন পান। ভারতে উন্নত চিকিৎসায় গেলেও একটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়। আজও তিনি ব্রেস, স্টিল সাপোর্ট ও ওষুধ ছাড়া হাঁটতে পারেন না। তার কথায়—আমি প্রতিদিন হাঁটি, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে মনে করিয়ে দেয়—আমি স্বাধীন দেশে গুলিবিদ্ধ এক রাজনৈতিক বন্দী।
চোখ হারিয়ে নিভে গেছে পৃথিবীর আলো—জাহাঙ্গীর আলমের জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই হিসাবে দেখছেন মিরের বাজার লড়াইকে। গাজীপুর মহানগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম সেদিন সরাসরি পুলিশের গুলিতে একটি চোখ হারান। চিকিৎসকরা তখন জানান—এমন ক্ষত সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায়। জাহাঙ্গীর আজও বলেন—চোখের আলো হারিয়েছি, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আলো নিভে যায়নি। তার জীবনযাপন আজও কঠিন, পেশাগত ও সামাজিক জীবন প্রতিদিন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় সেদিনের রাষ্ট্রীয় সহিংসতার নির্মমতা।
পূবাইল থানা সেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কামারুজ্জামান কাজলের শরীরে সেদিন চারদিক থেকে ছরার গুলি লাগে। চোখের সামনে পড়ে থাকা লুটিয়ে পড়া সঙ্গীদের দেখে তিনি বলেছিলেন, আমাদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছিল; সামনে বা পেছনে নয়—সরাসরি বুক বরাবর। তার শরীরে বহু গুলির ক্ষত এখনো দাগ হয়ে আছে। কাজলের রক্তাক্ত শরীর, পূবাইলে সেদিন মাটির রং লাল হয়ে উঠেছিল। যার ক্ষত তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো।
মিলন-বিকি-সুলতান-বকুল—সবাই গুলিবিদ্ধ: ইতিহাস বলবে, এটি ছিল রাষ্ট্রীয় অনুমোদিত আক্রমণ:
সেদিন আহত হন, বিএনপির গাজীপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রার্থী এ কে এম ফজলুল হক মিলন, নজরুল ইসলাম খান বিকি, সুলতান উদ্দিন চেয়ারম্যান, মনির হোসেন বকুলসহ আরও বহু নেতাকর্মী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান—এসআই হারিছের নির্দেশেই পুলিশ গুলি চালায়। বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এসআই হারিছ গুলিবর্ষণের পর দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। ১২ বছর পরও জানা যায়নি তিনি কোথায়। এখনো পর্যন্ত কোনো তদন্তে তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা হয়নি। তাকে খুঁজে বের করে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
সেইদিনের উল্টো মামলা—উল্টো শাস্তি: এই রাষ্ট্রযন্ত্র তখন কাদের হয়ে কাজ করছিল? এমন প্রশ্ন রেখে অনেকেই বলছেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—যারা রক্তাক্ত, পঙ্গু, চোখ হারিয়েছে—তারা যখন মামলা করতে জয়দেবপুর থানায় যান, পুলিশ মামলা নেয়নি। বরং উল্টো আহতদেরই বিরুদ্ধে দায়ের হয় নাশকতা ও সন্ত্রাসের মামলা। ভিকটিম প্রত্যেকের নামে ২০-৩০টি করে গায়েবি মামলা, যা ১২ বছর পরও অনেকের কাঁধে বোঝা হয়ে ঝুলে আছে। অনেকেই মাসের পর মাস কারাগারে কাটিয়েছেন, অনেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে নির্বাসনে থেকেছেন। এখনো অনেক মামলা আদালতে ঝুলে রয়েছে—যার কোনো সুষ্ঠু তদন্তই হয়নি। এই রাজনৈতিক মামলা থেকে তারা দ্রুত অব্যাহতি চান।
শাসন পরিবর্তনের পরও ক্ষোভ রয়েই গেছে:
শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পরে এক আহত নেতার করা মামলায় স্থানীয়দের দাবি—আওয়ামী লীগের যারা সরাসরি হামলায় জড়িত ছিল, তাদের অনেককেই বাদ দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া কিছু নেতাকর্মী দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসেছে—এ নিয়ে ত্যাগী নেতাকর্মীদের ভেতরে অসন্তোষ এখন চরমে। তাদের প্রশ্ন—“আমাদের রক্ত কি ব্যর্থ হলো?”
১২ বছর পরও পূবাইলের মানুষের আকুতি—ন্যায়বিচার চাই:
এই দীর্ঘ বছরের অবিচার, মামলার বোঝা, চিকিৎসাজনিত ঋণ ও দুঃখ নিয়ে অসংখ্য পরিবার আজও কাঁপছে। মায়েরা সন্তান হারানোর শোকে আজও কথা বলতে পারেন না। স্ত্রীরা স্বামীকে হাসপাতালে বাঁচিয়ে বাড়িতে এনেও ভাঙা জীবন নিয়ে সংগ্রাম করছেন। সন্তানরা বাবা পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলেছে। সেদিনের সময়-তারিখ, গুলি, ছরার আকার, পুলিশের অবস্থান, সাক্ষী, চিকিৎসকের বিবরণ—সবকিছুই আজও বলে দেয়: এটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন ছিল।
ভবিষ্যতের পথ—সংঘাত ভুলে ঐক্যের ডাক দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন—এখন সময় ক্ষত ভুলে নয়, বরং ক্ষত থেকে শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চাইছে। ৩১ দফা বাস্তবায়ন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, এই প্রত্যয় নিয়েই তারা এগিয়ে যেতে চান। তাদের বিশ্বাস—মিরের বাজারের সেই রক্তের দাম একদিন অবশ্যই মিলবে।
আপনার মতামত লিখুন :