পাবনায় আটটি কুকুর ছানা পানিতে ডুবিয়ে অমানবিকভাবে মারার ঘটনা যখন দেশে ভাইরাল। তখন অপরদিকে একজন মানবিক পশু-পাখি প্রেমী রাজশাহী মহানগরীর দেবীশিংপাড়া নিবাসী প্রকৌশলী খাদেমুল ইসলাম এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তখনও ভোর হয়নি। কোন কোন মসজিদে ফজরের নামাজের আজান শুরু হয়েছে। এই সময়ে একজন মানবিক মানুষ একান্ত মনে হেটেই চলেছেন। তার দুই হাতে দুটো ব্যাগ। খাবারে পরিপূর্ণ। বাড়ি থেকে বেরুতে সামনে হাজির ৮/৯ টি পথকুকুর সামনে এগিয়ে এলে ভদ্রলোক তাদের মুখে খাবার তুলে দিলেন। এরপর আবার হাটা শুরু। গন্তব্য ঠিক করাই আছে। পুরো চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গিয়ে স্থানে স্থানে যতগুলো পথকুকুর সামনে আসে তাদের প্রত্যেককেই খাবার খাইয়ে ব্যাগ দুটো নি:শেষ করে বাড়ি ফেরা। আর এই সব পথকুকুরদের এমনই সময় জ্ঞান যে, যে সময়ে যার অপেক্ষা করার কথা তারা ঠিক ঠিক স্থানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আর লেজ নাড়িয়ে কৃতজ্ঞতা জানাই।
কি শীত, কি গরম কি বৃষ্টির রাত, একটা দিনও বিরাম নেই, নেই কোন ক্লান্তি বোধ। অবিরাম এই পথকুকুরদের মুখে তিনি খাবার তুলে দিচ্ছেন, এতে তার কোন সহযোগী নেই, কারুর কাছ থেকে তিনি সাহায্য নেননা, পেনশন যা পান তার একটা বড় অংশ ব্যয় করছেন তিনি পথকুকুর আর অবলা পশু পক্ষীদের কল্যানে।
তিনি ছিলেন প্রজাতন্ত্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। বিসিএস ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের সদস্য। আজ ৬৬ বছর বয়সে তিনি একক ভাবেই পথকুকুরদের সেবা করে যাচ্ছেন আর এতে তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা মিতু এবং পুত্র কন্যা অবলীলায় সমথর্ন জানিয়ে আসছে। কারো কোন বিরক্তি নেই বা বাধা নেই।
তার দিন শুরু হয় ভোররাত চারটা থেকে। তিনি নিজের হাতে কুকুরদের জন্য ভাত আর মাংসের হাড়গোড় রান্না করেন। সেটা মাখিয়ে বালতিতে ভরে নেন একটা ব্যাগ আর অন্য ব্যাগে পরিপূর্ণ করেন বাটা বিস্কুট। এই বিস্কুট আবার কুকুরের খুব পছন্দ।
পুরো রাস্তায় ভোরের কাজ শেষ হলেই তিনি বাসায় এসে কাকদের জন্য রুটি ছিড়ে ছিড়ে টিনের চালে ছড়িয়ে দিলে অগনিত কাক উড়ে আসে রুটি ভক্ষণ করার জন্য। কাকের রুটি বিতরনের পর ছাদের কারনিশে নিদ্দিস্ট স্থানে ভাত দিয়ে রাখেন। সেখানে সেই কাক ডাকা ভোর থেকে একে একে আসতে থাকে কবুতর, শালিক, ঘুঘু, ফিংগে, কাঠঠোকরা, বাবুই, চড়ুই, সাত ভাইয়া সহ অনেক অনেক নাম না জানা পক্ষীকুল। শুধু কি তাই? আসে কাঠ বিড়ালীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদেরকে পরিমানমতো ভাত ও অন্যান্য খাবার দেন তিনি।
নিজের হাতেই তিনি সারাদিনে তিনবার ভাত রান্না করেন চার কেজি চাউলের। আর হাড্ডি রান্না করেন। এই ৬৬ বছর বয়সে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৫-৬ ঘন্টা ব্যয় করেন পথকুকুর আর অবলা পাখিদের পেছনে।
সকাল বেলা একবার, বিকেলে একবার এবং রাতের বেলা ভাত রান্না যেন রুটিন ওয়াক। এর সাথে আছে দুপুরে ও রাতে এক্কেবারে সময় করে বাড়ির সামনে থাকা ১০/১২ টি কুকুরকে আহার করানো। এরা এতটাই ভক্ত এবং সময় জ্ঞান এতটাই প্রকট যে জাস্ট টাইম নো কমপ্লেইনের মতো এরা বাড়ির সামনে এসে হাজির। এরা এতটাই স্মৃতিশক্তিপ্রবন যে ভদ্রলোকের শরীরের ঘ্রাণ তাদের মুখস্থ। কমিউনিটি সেন্টারে যেদিন অনুষ্ঠান থাকে সেইদিন তিনি খাবাবের উচ্ছিষ্ট গুলো বাড়িতে এনে সেগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে প্যাকেট করে ডিপফ্রিজে রেখে দেন। প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করে কেবলমাত্র কুকুরের খাবার সংরক্ষণ করার জন্য ডিপফ্রিজ কিনেছেন তিনি।
ভোররাতে চারটা থেকে একাই এই কাজ করে চলেছেন তিনি। প্রতিদিন বিরক্তি ছাড়াই এই অবলা পশু পক্ষী প্রাণীদের সেবা করে তিনি এক ধরনের স্বগীয় সুখানুভূতি অনুভব করেন।
প্রকৃত সমাজসেবক বলতে যা বোঝায় সেটা একমাত্র তাকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব। একক উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও স্বেচ্ছাশ্রমের দ্বারা তিনি চাপাইনবাবগঞ্জ চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখানে প্রতিদিন আড়াই শতাধিক গরীব ও অসহায় চক্ষু রোগী নামমাত্র ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা সহ অপারেশন করাচ্ছেন। রাজশাহীতে যে ন্যাশনাল হাট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার পেছনেও তার প্রচন্ড স্বেচ্ছাশ্রম রয়েছে। একক উদ্যোগে তিনি কেবলমাত্র ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বাংলাদেশে প্রথম প্রকোশলী পল্লী আবাসন প্রকল্প তৈরী করেছেন রাজশাহী মহানগরীর বড় বনগ্রাম এলাকায়। তিনি যা কিছু করেছেন তা মানব কল্যাণে কিন্তু তিনি যাদের জন্য এত কিছু করেছেন তাদের ভেতরে দেখেছেন অকৃতজ্ঞতা কিম্বা কৃতঘ্ন। আর সে কারণে এখন তার মনোনিবেশ অবলা পশু পক্ষীদের জন্য যারা কখনোই বেঈমানী করবেনা বরং তারা কৃতজ্ঞতার সাথেই সুখ দিচ্ছে।
এই মানবিক ও সমাজসেবী মানুষটি স্থানীয়ভাবে প্রকৌশলী ফিকশন ইসলাম নামেই সবার কাছে পরিচিত। তার একান্ত ইচ্ছে অবলা প্রভুভক্ত বিশ্বাসী ও কৃতজ্ঞ পথকুকুরদের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় স্থলের।
আপনার মতামত লিখুন :