বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক: রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না-করা নিয়ে কিছুটা উভয়সংকটে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার বিষয়ে অনড়। অন্যদিকে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে।
বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা এবং দলটিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার দাবিতে সোচ্চার। তাঁরা নির্বাচনের আগে জরুরি সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার আছে কি না, সে প্রশ্নের সুরাহা চান। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অগ্রাধিকার নির্ধারণ নিয়ে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এটা ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটা করেছে, বলেছে সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতিমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করব না।’
গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। এই ক্ষেত্রে বিএনপি একটা বাধা, রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা প্রতিহত করতে প্রয়োজনে ‘দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের’ হুমকি দিয়েছেন।
সরকার, বিএনপি, ছাত্রনেতা-যার যার কৌশলে ব্যস্ত
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই ছাত্রনেতারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করে আসছেন। এরই মধ্যে গত ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে মাঠে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে এসেছে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিএনপির সায় পাচ্ছে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর আগে আওয়ামী লীগের নিয়োগ করা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবিতেও ছাত্রনেতাদের মতো করে বিএনপি সাড়া দেয়নি। রাষ্ট্রপতি ইস্যুকে কেন্দ্র নতুন কোনো সংকট তৈরি হতে পারে, সে আশঙ্কায় দলটি ওই পথে হাঁটেনি বলে বিএনপি সূত্রে জানা যায়।
এখন প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রশ্নে বিএনপির অবস্থানের কথা জানার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সারজিস লেখেন-‘গণহত্যার বিচারের পূর্বে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
একই বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘ছেলেদের রক্তের ওপর পা রেখে দিল্লিকে কিবলা বানিয়ে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জনগণের মুক্তির নিয়তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আওয়ামী পুনর্বাসনের জন্য যারা উদ্যোগ নেবে, তাদের ইতিহাস গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে।’ তিনি আরও লেখেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে যারা ধারণ করে, যারা গণমানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চায়, তারা চব্বিশ পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি ছাড়া আওয়ামী লীগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আর কোনো বক্তব্য দিতে পারে না।’
নাম উচ্চারণ না করলেও এসব বক্তব্য যে বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে সেটা অনেকটা স্পষ্ট। এই দুই প্রভাবশালী ছাত্রনেতার এ ধরনের বক্তব্য সরকার ও বিএনপির ওপর এক ধরনের চাপ বলে মনে করে রাজনৈতিক মহল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে ফ্যাসিবাদের সমর্থক জনগোষ্ঠীকে তাঁরা প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘গত ১৬ বছরে বিএনপি সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমরা প্রত্যাশা করি সংস্কার ও ফ্যাসিবাদ বিলোপের চলমান যাত্রায়ও বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
হাসনাত আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘বিএনপির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশা ও বিএনপির বর্তমান কার্যক্রমের মধ্যে ঘাটতি রয়েছে বলে যদি মানুষ মনে করে, তা মনে করতেই পারে। আমরা চাই, বিএনপির ফ্যাসিবাদবিরোধী যে আপসহীন মনোভাব ছিল, সেই মনোভাবটাই তারা অব্যাহত রাখবে।
এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা না-করার সিদ্ধান্তের বিষয়টি ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশের সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। খসড়াটি অনুমোদনের জন্য আজ বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। খসড়া আইনে রাজনৈতিক দলের বিচারের ধারা যুক্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আদালতকে সেভাবে সরাসরি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে আদালত যদি মনে করেন তাহলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করতে পারবে।’
নির্বাচন কত দূর
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে নির্বাচন দিতে চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মতও একই। বিএনপি সংস্কার চায় না, এ কথা সরাসরি বলছে না। তবে দলটি এখনই নির্বাচনের রোডম্যাপ বা দিন-তারিখ চায়। অতি জরুরি সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচন চায়।
গত রোববার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের বিষয়ে বলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’
অন্তর্বর্তী সরকার-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমান সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে। ছাত্র-জনতার চাওয়াও সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান। ফলে বিএনপির চাওয়া যা-ই হোক, নির্বাচন ও সংবিধান সংক্রান্ত নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার শেষ করেই নির্বাচনে যেতে চায় সরকার। এখন পর্যন্ত এটাই সরকারের মনোভাব।
গত সোমবার সচিবালয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কমনওয়েলথের সহকারী মহাসচিব অধ্যাপক লুইস ফ্রান্সেচি। এ সময় নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেয়ারটেকার সরকার নয়। তাই শুধু নির্বাচন দেওয়াই এই সরকারের কাজ নয়। ইতিমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে।’
গতকাল সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তব্যেও অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে। আর ছাত্রনেতারা উল্টো ‘আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের’ অভিযোগ এনে বিএনপিকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে।