বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৭ অপরাহ্ন
সময়টা ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাত ১০টা। চট্টগ্রামের বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলাউদ্দিন ডিউটি শেষ করে বাসার উদ্দেশে সিইউএফএল ঘাটের পাশের খেয়াঘাট থেকে নৌকা নিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হন। বন্দর ফাঁড়িতে দায়িত্ব পালনের আগে তিনি নদীর ওপারের কয়লার ডিপো ফাঁড়ির দায়িত্বে ছিলেন। মাত্র চার দিন আগে কয়লার ডিপো ফাঁড়ি থেকে তাকে বদলি করা হয়। একইভাবে বন্দর ফাঁড়ির হেলাল উদ্দিনকে বদলি করা হয় কয়লার ডিপো ফাঁড়িতে। এর মধ্যে তারা উভয়ে বাসাও পরিবর্তন করতে পারেননি। সেদিন বাসায় ফেরার পথে আলাউদ্দিনের সঙ্গে কয়লার ডিপো ঘাটে হেলাল উদ্দিনের দেখা হয়। তারা দুজন একই ব্যাচের হওয়ায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। হেলালকে বিদায় দেওয়ার পর বন্দর ফাঁড়ি থেকে হাবিলদার গোলাম রসুলের ফোন আসে। তিনি আলাউদ্দিনকে জানান সিইউএফএল ঘাটে অস্ত্র আসছে বলে তিনি খবর পেয়েছেন। ফোন পেয়ে হেলালকে নিয়েই সিইউএফএল ঘাটে চলে যান আলাউদ্দিন। যদিও হেলালকে সেখানে নেওয়ার কোনো দাপ্তরিক অনুমতি আলাউদ্দিনের ছিল না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমকে আলাউদ্দিন ও হেলালের দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য উঠে আসে। সেই তথ্য থেকে জানা গেছে, পরবর্তী সময়ে আলাউদ্দিন বলেছিলেন, যেহেতু হেলাল সেখানে আগে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাকে সবাই চেনেন। কাজের সুবিধার্থেই তাকে তিনি নিয়েছিলেন। সিইউএফএল থেকে কয়লার ডিপো ফাঁড়ির অবস্থান কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ পাড়ের বিপরীতে। সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পান, দুটি ট্রলার একটি আরেকটির সঙ্গে লাগোয়া দাঁড়িয়ে আছে। কিছু শ্রমিক ট্রলার থেকে ক্রেনের সাহায্যে কাঠের বাক্সগুলো নামিয়ে ঘাটে থাকা ট্রাকে তুলছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দীন মোহাম্মদ, আবুল কাশেম মধু, আরজু পাগলা। তারা প্রত্যেকে অস্ত্র মামলার আসামি। ঘটনার দিন আলাউদ্দিন যখন সিইউএফএল ঘাটের পাশের খেয়াঘাট থেকে পার হচ্ছিলেন, তখন ঘাটে কোনো নৌযান ছিল না। দীন মোহাম্মদ সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে দেখে নদী পার হওয়ার জন্য একটি নৌকা ঠিক করে দেন। সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিনসহ আবার যখন সেখানে পৌঁছান আলাউদ্দিন, তখনও তাদের সঙ্গেই দেখা হয়। বাক্সগুলো নামাতে দেখে সার্জেন্ট হেলাল তার পূর্বপরিচিত শ্রমিক সর্দার আরজু পাগলাকে জিজ্ঞেস করেন মালগুলো কার? কে এনেছেন? তখন তিনি বলেন, মালের মালিক ঘাটেই আছেন। পরে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ঘাটে বাক্সের মালিককে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। একপর্যায়ে হাফিজ ও আবুল হোসেন (উলফার শীর্ষস্থানীয় নেতা) নামে দুজন জানান, মালগুলোর মালিক তারাই।
এ সময় আবুল হোসেন ও হাফিজ কোনো কথা না ঘুরিয়ে বলে দেন যে বাক্সগুলোতে অস্ত্র রয়েছে। এগুলোর ব্যাপারে প্রশাসন অবগত আছে। অস্ত্রগুলোর বৈধ কাগজপত্র আছে কি না জানতে চান পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা। কিন্তু এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন হাফিজ। তিনি বলেন, ‘কিসের কাগজ? এই অস্ত্র আসার খবর সরকারের উচ্চ পর্যায়েও জানে। এগুলো নামাতে বাধা দিলে আপনার ক্ষতি হবে।’ একপর্যায়ে পুলিশ ও অস্ত্র খালাসকারীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হলে শ্রমিকরা একে একে সরে পড়েন। এরপরও খালাসকারীরা বলছিলেন পুলিশের বাধা দূরে থাক, উল্টো কোস্টগার্ড এসে এগুলো খালাস করে দেবে। কিন্তু উভয় পক্ষের বাগবিতণ্ডায় একপর্যায়ে অস্ত্র খালাস বন্ধ হয়ে যায়। ততক্ষণে বন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও কর্ণফুলী থানা থেকে বিপুল পরিমাণ পুলিশ সদস্যসহ ওই থানার সেই সময়ের ওসি আহাদুর রহমান উপস্থিত হন।
এরপর দুই সার্জেন্ট অস্ত্র খালাসকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষির চেষ্টা করেন। কিন্তু হাফিজ সমঝোতার পরিবর্তে প্রশাসনের বড় কর্তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ওই সময় হাফিজ মুঠোফোনে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে হাফিজ তার মুঠোফোনটি সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে দিয়ে বলেন, ‘তোর বাপের সঙ্গে কথা বল। ডিজিএফআইয়ের বড় অফিসার লাইনে আছেন।’ কিন্তু সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ভয়ে কথা বলেননি। উল্টো তিনি বলেন, ‘আমি এবার তোমার বাপকে ফোন দিচ্ছি, দেখি তোমাকে কে বাঁচায়?’ এরপর তিনি হেলালের সঙ্গে পরামর্শ করে উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি-পোর্ট) আবদুল্লাহ হেল বাকিকে মুঠোফোনে অস্ত্র খালাসের বিষয়টি জানান। একই সঙ্গে তিনি আশপাশের সব ফাঁড়ি থেকে পুলিশ পাঠানোর আবেদন জানান। ডিসি (পোর্ট) আবদুল্লাহ হেল বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তাকে জানান। সেইসঙ্গে আশপাশের সবাইকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার বার্তা দিয়ে নিজেও আসছেন বলে জানান।
এ সময় হাফিজের সঙ্গে থাকা আবুল হোসেন কেউ একজনের মুঠোফোনে কথা বলেন এবং আলাউদ্দিনকেও কথা বলার অনুরোধ করেন। আলাউদ্দিন ফোন নিয়ে কথা বললে অপর প্রান্ত থেকে নাম প্রকাশ না করে একজন বলেন, ‘দেখেন আমরা ১৯৭১ সালে আপনাদের স্বাধীনতায় অনেক সহযোগিতা করেছি। এই অস্ত্রগুলোও আপনাদের মতো আমাদের একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সৃষ্টিতে কাজে লাগবে, আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না। দয়া করে অস্ত্রগুলো খালাসে বাধা দেবেন না।’ এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাদের পরিচিত বিভিন্ন বাহিনীর (পুলিশ, বিডিআর, কোস্টগার্ড) সদস্যদের ফোন দেন।
পুলিশের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, সেখানে ওই দিন হাফিজ পুলিশকে বড় অঙ্কের টাকা দিতে প্রস্তাব দেন। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ টাকা নিতে রাজি হয়নি। ইতোমধ্যে সেখানে মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হন। এভাবেই রাতের মধ্যে অস্ত্র চালানের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে অস্ত্রগুলো ছেড়ে দেওয়ার কোনো পরিস্থিতি ছিল না। ফলে প্রশাসন ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানা যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চট্টগ্রাম মহানগর পিপির দায়িত্বে থাকা অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন, ‘আমি পিপি থাকাকালেও লুৎফুজ্জামান বাবররা আসামি ছিলেন না। পরবর্তীতে ওয়ান-ইলেভেনের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের আসামি করা হয়।’ সিনিয়র আইনজীবী এনামুল হক বলেন, আজ (বুধবার) যে রায় ঘোষণা হয়েছে তাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেননা যারা খালাস পেয়েছেন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আসামি করা হয়েছিল।