বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৭ অপরাহ্ন

রেলের সাড়ে ৩০০ একর জমি দখলের মূলহোতা মোকছেদুল মোমিন

রেলের সাড়ে ৩০০ একর জমি দখলের মূলহোতা মোকছেদুল মোমিন

বিশেষ প্রতিনিধি:
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার লোহা টেন্ডারবাজিসহ অবৈধভাবে বিক্রি করায় স্থানীয়রা তাকে ‘লোহা ভাইজান’ বলে ডাকা শুরু করেন। বাবার হাত ধরে আসেন কারখানায় শ্রমিক লীগের রাজনীতিতে। একসময় বাগিয়ে নেন কারখানা শাখার সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে রেলওয়ে কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সেখানকার অপ্রতিরোধ্য ‘গডফাদার’। সৈয়দপুর রেল কারখানায় টেন্ডারবাজি, কারখানার লোহা চুরি করে বিক্রি, শহরের রেলওয়ে এলাকার মুন্সীপাড়ার রেল কোয়ার্টার দখল করে বিক্রি, জোড়াতালায় পুকুর ভরাট করে বিক্রিসহ নানা অপকর্মের মূল হোতা মোকছেদুল মোমিন। ছিলেন সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। টানা দুবার উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পর নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার মালিক হন তিনি। জানা গেছে, ১৯৭৭ সালের ১ ডিসেম্বর সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে মিস্ত্রি পদে চাকরি নেন মোকছেদুল মোমিন।

২০১৭ সালে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। তার অবসরপ্রাপ্ত টিকিট নম্বর ৬০১৬। ২০১১ সালে তার সর্বশেষ বেতন স্কেল ছিল ১৩ হাজার টাকা। তবে ২০১২ সালে প্রায় ২ কোটি খরচ করে শহরে নির্মাণ করেন রাজকীয় বাড়ি। সৈয়দপুর শহরের রেলের সম্পত্তির বড় দখলদার ছিলেন মোকছেদুল মোমিন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে রেলের জমি দখল করে তাতে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। কোয়ার্টার বিক্রি করেছেন। রেলওয়ের লোহা বিক্রি হতো তার নির্দেশনায়। রেলওয়ে কারখানায় একক আধিপত্য ছিল তার। কেপিআই অন্তর্ভুক্ত সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপের ১২ নম্বর গেটের সামনে প্রায় ২ একর জায়গা দখল করেন মোকছেদুল মোমিন। সেখানে ২০১৫ সালে তার বাবার নামে নির্মাণ করেন শামসুল হক মেমোরিয়াল একাডেমি। তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এর উদ্বোধন করেন। সৈয়দপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সভাপতি থাকাকালে স্কুলের মাঠে দেড় শ বছরের ঐতিহ্যবাহী বি আর সিং ইনস্টিটিউট ভবন ভেঙে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ইট ও রড বিক্রি করেন মোমিন। তিনি রেলওয়ে কোয়ার্টারের সিলগালা তালা ভেঙে টি-১৪ নম্বর বাংলো বিক্রি করে দেন। বাংলো এলাকায় বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেন। তার বাহিনীর ‘ফার্স্ট-ইন-কমান্ড’ দিল নেওয়াজ খানসহ আরও কিছু পাতি নেতা তাকে দখলে সহযোগিতা করেন। কেবল মোকছেদুল মোমিন নিজে নন, তার পছন্দের লোকেরাও রেলের সম্পত্তি দখল ও তা বিক্রি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। রেলের কোয়ার্টার দখল, মাদক ব্যবসাসহ তার বাহিনীর বিভিন্ন অপকর্মের মদদদাতা ছিলেন মোমিন। শহরের সাড়ে ৩০০ একর জমি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও ভূমিদস্যুরা দখল করেছেন। এসব জমির মূল্য ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। দখল করা জায়গায় নির্বিঘ্নে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য বহুতল ভবন।

 

কোনো কোনো স্থানে এসব জমি কৌশলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। রেলের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই এসব অপকর্ম করেছেন তারা। উল্লেখ্য, সৈয়দপুর রেলের মোট জমি ৭৯৮.৯৯ একর। এর মধ্যে শহর এলাকায় প্রায় সাড়ে ৩০০ একর বেদখলে হয়েছে। সেখানে দখলদারদের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। রেলওয়ে কারখানা শাখার শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ২০১৭ সালে উপনির্বাচনে সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে জনপ্রতিনিধির খাতায় নাম লেখান মোকছেদুল মোমিন। ২০১৯ সালে আবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৭ সালে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় বছরে তিন লাখ টাকা আয় দেখান তিনি। তখন সব মিলিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১০ লাখ টাকার মতো।

 

টানা দুবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। রেলের কেপিআই অন্তর্ভুক্ত এলাকায় নির্মাণ করেন রেল শ্রমিক লীগের কার্যালয়। স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বলছেন, নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মামলা-হামলার মাধ্যমে হয়রানি করেছেন মোকছেদুল মোমিন। নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও তার নির্যাতন থেকে বাদ যাননি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দমন করতে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব বাহিনী। আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী ও মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে অবৈধ সব কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন মোকছেদুল মোমিন। তার ঘনিষ্ঠ এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মোকছেদুল মোমিন ওরফে ভাইজানের আয়ের মূল উৎস ছিল রেলের সম্পত্তি দখল করে বিক্রি করা। রেলওয়ে কারখানার টেন্ডারবাজি ও মাদক বিক্রির টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠেন মোমিন। নীলফামারী জেলা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রভাষক শওকত হায়াত শাহ্ বলেন, ‘দলের হাইকমান্ডের কাছে গুরুত্ব বাড়াতে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমার নেতা-কর্মীদের মারধর, খুন-জখম করেছেন মোকছেদুল মোমিন। গত ১৫ বছর শহরে আমাদের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি। ন্যূনতম রাজনৈতিক শিষ্টাচার ছিল না তার মধ্যে।

গত ৫ আগস্ট সকালেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে ব্যস্ত ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোকছেদুল মোমিন। ওই দিন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পতনের আগে আগে তিনি আত্মগোপনে যান। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা শহরের মিস্ত্রিপাড়ায় তার বাড়িতে হামলা চালান। খামার থেকে নিয়ে যান গরু। ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বাড়িটি। তিনি আত্মগোপনে থাকায় এসব দুর্নীতি ও অপকর্মের ব্যাপারে তার মন্তব্য নেওয়া যায়নি।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2025 Protidiner Kagoj |