‘সবাই বলতো, তুই আমাদের কেউ না। ছেলেরা টিটকারি করতো, হাঁটাচলা মেয়েদের মতো বলে কটূক্তি করতো। মানুষ নয়, বরং তিরস্কার করে হিজড়া বলে ডাকে। পথের শিশুর মতো আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো। কখনো মারধর, কখনো প্যান্ট খুলে আমাদের শরীর দেখে হাসাহাসি করত। সবচেয়ে কষ্টের ছিল, পরিবার, স্কুলের সহপাঠী, এমনকি শিক্ষকরাও চাননি আমি স্কুলে পড়ি।’
নিজের জীবনের এমন বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা জানান পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার পাটোয়ারীপাড়া গ্রামের শাকিলা, যে বয়সে তার বই-খাতা নিয়ে স্কুলে ছুটে যাওয়ার কথা, সে বয়সেই তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্মম বাস্তবতার।
বঞ্চনার বেড়াজালে বেড়ে ওঠা শিশুরা
উত্তরের পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থেকে কিছু দূরে সবুজে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম পাটোয়ারীপাড়া। এখানেই গুরুমা তার শিষ্যকন্যাদের নিয়ে কয়েক বছর আগে সংসার গড়েছেন। গ্রামটিতে বসবাসরত তৃতীয় লিঙ্গের ১৫ জন মানুষের মধ্যে তিনজন শিশু রয়েছে, যারা জন্মের পর থেকেই সমাজের অবহেলা আর নির্যাতনের শিকার।
শারীরিক পার্থক্যের কারণে, সমাজের অন্যান্য হিজড়া সম্প্রদায়ের মতো এ শিশুগুলোকেও গান-নাচ কিংবা ভিক্ষার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য করা হয়। অথচ তাদেরও ইচ্ছে করে স্কুলে যেতে, খেলাধুলা করতে, সাধারণ শিশুর মতো হাসতে-খেলতে বড় হতে। কিন্তু সমাজের কটূক্তি আর বৈষম্য তাদের সেই স্বপ্ন চুরমার করে দেয়।
তৃতীয় লিঙ্গের শিশু সকাল জানায়, ‘হিজড়া হওয়ায় কেউ আমার পাশে বসে না। আমি বসলে সবাই উঠে যায়। বন্ধুরা তো দূরের কথা, শিক্ষকরা পর্যন্ত ভালো চোখে দেখে না। তাই বাধ্য হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছি। ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হব, কিন্তু তা আর হলো না।’
স্বপ্না নামে অপর এক শিশু বলে, ‘আমি মা-বাবার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম, তাদের স্নেহ পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমাজ আমাকে সেই অধিকার দেয়নি। বাবা-মা হয়তো রাখতে চাইতেন, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে আমি বাড়ি ছেড়েছি।’
গুরুমার আশ্রয় আর নতুন স্বপ্ন
সমাজ থেকে বিতাড়িত এসব শিশুদের আশ্রয় দিয়েছেন গুরুমা শিউলি। তিনি বলেন, ‘আমাকেও একসময় বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আমি জানি, পরিবার ছাড়া থাকলে কেমন কষ্ট হয়। তাই আমি তাদের নিজের সন্তান মনে করি। বর্তমানে আমার কাছে ২০ জন আছে, তাদের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুরাও রয়েছে। আমি চাই, তারা যেন মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।’
সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয়
নীলফামারী সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক মোঃ সোলায়মান আলী বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কিছু স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, সমাজে তারা এখনো অবহেলার শিকার। ফলে তারা অনেক সময় অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। অথচ উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে তারাও দেশের গর্বিত মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারে।’
গণমাধ্যম ও মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ন্যাশনাল প্রেস সোসাইটির (এনপিএস) রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়ক সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুরা কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। যদি তাদের শিক্ষার আওতায় আনা যায়, তাহলে তারা মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যেভাবে তাদের দূরে সরিয়ে রাখে, তা অন্যায়। সরকার এবং সাধারণ মানুষের সহানুভূতি ও সচেতনতা থাকলে এই শিশুরাও আগামীর আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে।’
তৃতীয় লিঙ্গের শিশুরাও আমাদের সমাজেরই অংশ। তারা অবহেলা, বিদ্রূপ কিংবা বঞ্চনার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। রাষ্ট্র ও সমাজ যদি তাদের শিক্ষার সুযোগ দেয়, তাহলে তারাও একদিন চিকিৎসক, শিক্ষক বা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে উঠতে পারে। সময় এসেছে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানোর—যেন শাকিলা, সকাল বা স্বপ্নাদের স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্ন হয়েই না থাকে।
আপনার মতামত লিখুন :