ছাত্র রাজনীতি: গৌরব, সংকট ও করণীয়

নিজস্ব সংবাদদাতা , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ১৪ জুন, ২০২৫, ০৯:৩৯ পিএম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ছাত্র রাজনীতি ছাড়া অকল্পনীয়৷ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থান - সবখানেই ছাত্রসমাজ ছিলো পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়৷ আর্দশিক রাজনীতি, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের কারিগর হিসেবে ছাত্র রাজনীতি ছিলো জাতির অন্যতম শক্তি৷ 

 

গৌরবের ধারা ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের গর্জে উঠাই ছিলো জাতির জাগরণের সূচনা৷ ১৮৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া সালাম রফিক বরকত জব্বাররা ছিলেন শিক্ষার্থী৷ ১৯৬৭-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সংগঠনের ছিলো অগ্রণী ভূমিকা৷ ১৯৯০ এর স্বৈরাচার পতন এবং সর্বশেষ ২০২৪ এ স্বৈরাচার পতনের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র ঐক্যই ছিলো মূল চালিকাশক্তি৷ তৎকালে ছাত্র রাজনীতি ছিলো আর্দশনির্ভর, শিক্ষার্থী ও জাতির সমস্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে তোলা, ত্যাগের আর্দশে বলীয়ান এবং নেতৃত্বের মানোন্নয়ন৷ মেধাবী, চিন্তাশীল, সাহসী ও বুদ্ধিমানরাই ছিলেন নেতৃত্বের আসনে ফলে রাজনীতিতে থাকতো সেবা ও আর্দশের অনুশীলন৷ 

 

চিত্র পাল্টে গেছে৷ দূভাগ্যজনকভাবে ছাত্র রাজনীতির গৌরবগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে দলীয় লেজুড়বৃত্তিকরণ ছাত্র রাজনীতির মেরুদণ্ডটাই ভেঙ্গে দিয়েছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো অনেকটাই পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলের ছায়া বাহিনী হিসেবে৷ হল দখল, ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, শিক্ষক লাঞ্চনা এবং ভিন্নমতের উপর শারিরীক নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে৷ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের মহড়া, পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্ন, সেশনজট সূষ্টির পেছনে ছাত্র রাজনীতির নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে৷  আরও উদ্বেগজনক হলো- এখানে নেতৃত্ব তৈরি হয় মেধা, আর্দশিক গুণাবলি ও চিন্তাশীলতার ভিত্তিতে নয়; বরং পাল্লা দিয়ে পোস্টারিং, শক্তি ও জনবল প্রদর্শন এবং পদবাজি দিয়ে৷ তাই অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসবে ভয় পায় এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি মনে রাজনীতিতে আসতে চায়না তথা আই হেইট পলিটিক্স নীতিতে বিশ্বাস করে৷ যদিও বারংবার দলীয় লেজুড়বৃত্তিহীন ছাত্র রাজনীতির আশার বাণী ফুটেছিলো তবে সেটা সফল হয়নি৷ 

 

ছাত্র রাজনীতির এহেন অধ:পতনের পেচনের কারণগুলো কী? রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে ছাত্র সংগঠনকে শুধুমাত্র ক্ষমতা লাভ ও জিইয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে, শিক্ষাক্ষণে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি ও দলীয় প্রভাবিতকরণ, আর্দশভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি, এহেন কর্মকান্ড রাজনীতিকে সামাজিকভাবে নোংরা হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমুখতা তৈরি করে৷ 

 

যদিও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় সংগঠন রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ হয়ে সমাজসেবামূলক, পরিবেশবান্ধব, শিক্ষামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে৷ বির্তক সংগঠন, সোশ্যাল এক্টিভিজম, উদ্যোক্তা ক্লাব, বইপড়া ও পরিবেশে আন্দোলন - এসব প্ল্যাটফর্মে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব তৈরি করছে গঠনমূলক পদ্ধতিতে৷ তবে গণতন্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা, নেতৃত্ব বিকাশে, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে এবং জাতির ক্রান্তিলগ্নে সুঠামদেহীর ন্যায় বীরদর্পে এগিয়ে এসে বুক চিতিয়ে দেওয়া অতীতের সেই সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতিরও প্রয়জন রয়েছে৷ তবে সেটি কার্যকর হবে আর্দশিক, গণতান্ত্রিক, সুষ্ঠু ও শিক্ষার্থীবান্ধ৷ ভবিষ্যতে ছাত্র রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন চাইলে এখনই কিছু সাহসী ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে৷ 

 

এক. ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি বিমুখ থেকে আর্দশের রাজনীতি করতে হবে৷ যে আর্দশে দেশের উন্নতি ও সম্মৃদ্ধ রয়েছে সেটা গ্রহণ করতে হবে৷ জাতির কল্যানে জনগনের সেবার নিজেকে বলীয়ান করতে হবে৷ দুই. দলীয় লেজুড়বৃত্তিকরণ সর্ম্পন্ন পরিহার করতে হবে৷ রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সংগঠনের উপর প্রভাব বিস্তার না করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া৷ রাজনৌতিক দলের বলয়ে থাকলে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হারায়৷ রাজনীতি হবে শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশের স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম৷ 

 

তিন. শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা৷ ছাত্র সংগঠনগুলোর কাজের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্ন হবে না৷ ক্যাম্পাসে অস্রধারণ, ভিন্নমতে হামলা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সহনশীল হতে হবে৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও একাডেমিক সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে৷ যাতে ছাত্র রাজনীতি আর্দশচর্চার জায়গা হয়ে উঠে৷ 

 

চার. মেধাবী, চিন্তাশীল, সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পন্ন, ক্রিয়েটিভ ও রানিং শিক্ষার্থীদের দলের নেতৃত্বে আনতে হবে৷ অছাত্র, বয়স্ক, বিবাহিত এবং নৈতিক গুণাবলীহীন কাউকে ছাত্র সংগঠনে না রাখা৷ পাঁচ. নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে হবে যাতে গণতান্ত্রিক চর্চা পূনরুজ্জীবিত হয়৷ শিক্ষার্থীরা নিজেদের পচন্দের, যোগ্য, সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পন্ন মেধাবী ও শিক্ষার্থীবান্ধব প্রার্থীকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করবে৷ এতে যোগ্যরা নেতৃত্বের আসনে স্থান পায় এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্বাচিত ছাত্রনেতার দায়বদ্ধতা তৈরি হয়৷ এতে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে ছাত্রনেতারা সম্মুখ সারথি হয়ে থাকবে৷ 

 

ছয়. সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ছাত্রসংগঠন ও ছাত্রনেতাদের৷ মাদক, দূর্ণীতি, অবিচার, শোষণ, সামাজিক ব্যধি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বজ্রকঠোর হতে হবে৷ সমাজ ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সর্বাত্তক সচেষ্ট থাকবে হবে৷ একটি জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের উপর৷ শিক্ষার্থীদের সুসংগঠিত, আর্দশিক ও নেতৃত্ববান গড়ে তুলতে হলে ছাত্র রাজনীতি হতে হবে ইতিবাচক, গণতান্ত্রিক, সমাজ ও শিক্ষার্থীবান্ধব৷ গৌরবের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সংকট নিরসন করে একটি শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতির ভীত এখনই গড়ে তুলতে হবে৷

 

ইয়াসির আরাফাত 

শিক্ষার্থী, এক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক 

জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়৷  

Link copied!