-স্বাধীন চৌধুরী
'বিপ্লব শুধুই অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়,
এ এক নিঃশব্দ প্রস্তুতি-
মানুষ হয়ে ওঠার যন্ত্রণা থেকে উঠে আসা এক অগ্নিমানস,
ভাঙা ঘর, ভাঙা স্বপ্ন, আর এক নব রূপের সন্ধান।'
বাংলার মাটি কখনো নিস্তরঙ্গ ছিল না।
এই মাটি যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে প্রশ্নের, প্রতিবাদের, প্রতিরোধের।
চৈত্রের খরতাপে ফেটে যাওয়া জমির মতোই, ফেটে বেরিয়েছে এক বিপ্লবী মানস।
এ চেতনা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নয়-
এ এক অস্তিত্বরক্ষার ধ্বনি, স্বপ্নের আত্মঘোষণা।
পূর্বরাগঃ প্রাচীন ধ্বনিতে চেতনার ছায়ালেখ
বাঙালির বিপ্লব বহু পূর্বেই শুরু হয়েছে-
যখন অস্ত্র নয়, প্রশ্ন ছিল মূল চালিকা।
চার্বাকের যুক্তিবাদ, বৌদ্ধ মানবতাবাদ, বৈষ্ণব প্রেমদর্শন কিংবা লালনের বাউল বাণী-
সবই ছিল নীরব সমাজবিপ্লব।
লালন বলেছিলেন-
'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি...'
এই উচ্চারণ এক ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তির দর্শন,
যেখানে ভেদাভেদ গলে গিয়েছিল মানবতাবাদের উনুনে।
ঔপনিবেশিক যুগঃ রক্তে লেখা জাগরণের গাঁথা
বিদেশি শাসন বাংলাকে কেবল শোষণ করেনি,
তার মগজে ও হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছিল প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
নীলকর সাহেবদের নির্মমতা যখন কৃষকের হাড় ভাঙছিল,
তখন নীল দর্পণ হয়ে উঠেছিল সাহসের প্রথম মঞ্চ।
ঈশ্বরচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রামমোহনের মতো মনীষীরা
প্রগতির আলো জ্বালিয়েছিলেন অন্ধকার সমাজে।
আর বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দে মাতরম্'-
বাঙালির কণ্ঠে তা হয়ে উঠেছিল এক স্বদেশী মহামন্ত্র।
যুব বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রামঃ বিপ্লবের লাল ক্যানভাস
উনিশ শতকের অন্তিমলগ্নে ও বিশ শতকের প্রারম্ভে
বাংলার আকাশে ছায়া ফেলল রক্তিম সূর্য।
ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়-বাদল-দীনেশঃ
তারা ছিলেন অগ্নিসন্তান,
যারা স্বাধীনতার মানচিত্র আঁকলেন আত্মত্যাগের রক্তে।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ইতিহাস কোনো কাব্য নয়,
তা ছিলো ইতিহাসের ভেতর জন্ম নেওয়া এক জীবনঘন রণদ্রোহ।
ভাষা আন্দোলনঃ কণ্ঠস্বর রক্ষার বিপ্লব
১৯৫২- একটি বছর, একটি ভাষা, কিছু তরুণ,
আর কিছু স্বপ্ন, যাদের শিরায় জেগেছিল বিদ্রোহ।
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...'
এই পঙক্তি বাঙালির আত্মপরিচয়ের ছাপচিত্র।
বাঙালি বুঝেছিল-
ভাষা শুধু মুখের উচ্চারণ নয়,
তা আত্মার পরিচয়, অস্তিত্বের মৌলিক অধিকার।
মুক্তিযুদ্ধঃ বিপ্লবের মহাকাব্য
১৯৭১ ছিলো বাঙালির বিপ্লবী চেতনার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি।
এই যুদ্ধ ছিল অস্ত্রের, ভাষার, সংস্কৃতির, পরিচয়ে
এ এক সর্বাত্মক আত্মমুক্তির সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল-
'এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।'
এ উচ্চারণ হয়ে উঠেছিল লক্ষ প্রাণের প্রেরণা।
মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন সকল শ্রেণির মানুষ-
শিক্ষক, কবি, কৃষক, ছাত্র, নারী-
তারা একসাথে রচনা করেছিলেন ইতিহাসের মহাকাব্য।
সমকালঃ বিপ্লবের রূপান্তরিত ভাষা
আজকের বিপ্লব আর অস্ত্রধারীর নয়-
এখন বিপ্লব ঘটে সমাজ সচেতনতায়,
মানবাধিকার আন্দোলনে, নারীর নিরাপত্তায়,
পরিবেশ-সচেতনতায়, তথ্যের মুক্ত প্রবাহে।
ডিজিটাল তরুণ প্রজন্ম কলমে, ক্যামেরায়, পোস্টে, কবিতায়-
আজও দাঁড়িয়ে থাকে অন্যায়ের মুখোমুখি।
তাদের চোখে প্রশ্ন, হৃদয়ে রক্ত, কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণ-
'আমরা চুপ করে থাকবো না।'
উপসংহারঃ চেতনার অগ্নিসেতু
বাঙালির বিপ্লব কখনো নিঃশেষ হয় না,
তা বারবার রূপ পাল্টায়, শব্দ বদলায়,
তবু আত্মা থাকে একই-
জ্বালামুখের মতো, যে প্রতীক্ষায় থাকে, জেগে ওঠার।
এই বিপ্লব চাষির মাঠে যেমন ছিল, কবির কলমেও তেমনই-
সবার অন্তরেই এক রকম সুর বাজে-
সেই সুর, যা জন্ম দেয় প্রতিরোধকে,
যা তৈরি করে নতুন ইতিহাস, নতুন সকাল।
'বাঙালি আজও জাগে, কারণ তার হৃদয়ে লুকিয়ে আছে
এক চিরন্তন দ্রোহী অগ্নিবীণা।'
###
তথ্যসূত্র ও অনুপ্রেরণাঃ
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (নৈতিক দর্শনের উৎস)
দীনবন্ধু মিত্র, নীল দর্পণ
বঙ্গীয় নবজাগরণ, সুশান্ত সরকার
ভাষা আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম: ড. আনিসুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ দলিলপত্র (বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত)
বিপ্লবী কবিতা: শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযান সংক্রান্ত সাক্ষ্য ও স্মারক।
১. অগ্নিরেখা: বাঙালির বিপ্লবী চেতনার মহাকাব্য
২. চেতনার শিখা, ইতিহাসের শরীর: বাঙালির বিপ্লবী মানসপট
৩. রক্ত, ভাষা ও স্বপ্নের প্রতিসন্ধি: বাঙালির বিপ্লবী উত্তরাধিকার
৪. দ্রোহের দীপ্তিতে গড়া জাতি: বাঙালির বিপ্লবের সুর
৫. জাগরণের জিন: বাঙালির চেতনায় বিপ্লবের ছায়া
৬. রক্তাক্ত মাটি, জেগে থাকা মানুষ: বিপ্লবী বাংলার ইতিবৃত্ত
৭. যে জাতির ইতিহাস প্রতিবাদের: বাঙালির বিপ্লবী আত্মজীবনী
৮. স্বপ্ন ও শপথে গড়া বাঙালি: বিপ্লবী চেতনার অনন্ত প্রবাহ
৯. যুদ্ধ, ভাষা, মানুষ: এক জাতির বিপ্লবী নকশা
১০. অগ্নিপথে বাঙালি: বিপ্লবের কাব্য ও করুণ গাথা।
আপনার মতামত লিখুন :