ভূমিকাঃ বাংলার ঋতুচক্রে শরৎকাল এক বিশেষ আবহ বহন করে। বর্ষার ঘনঘোর মেঘ আর অবিরাম বৃষ্টির পর শরৎ আসে নির্মল আকাশ, সাদা মেঘের ভেলা, কাশবন আর শিউলি ফুলের সুবাস নিয়ে। প্রকৃতির এই পরিবর্তন কেবল দৃশ্যমান নয়; এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও মানসিক অনুভূতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। তাই আশ্চর্য নয় যে, বাংলা সাহিত্যে শরৎকাল বারবার ফিরে এসেছে- কখনো প্রেম ও বিরহের প্রতীক হয়ে, কখনো কৃষকের ফসল ও শ্রমের প্রতিফলন হয়ে, আবার কখনো স্মৃতি ও নিস্তব্ধতার রূপক হয়ে।
আজকের দিনে, যখন শহুরে জীবন কংক্রিটের ভেতরে ঋতুর স্বাদ ম্লান করে দিচ্ছে, সাহিত্যের শরৎ আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কেবল নান্দনিক নয়, জীবনঘনিষ্ঠও।
প্রাচীন পদ থেকে বৈষ্ণব কবিতাঃ শরত আবহের সূচনাঃ
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে সরাসরি শরতের উল্লেখ কম হলেও ঋতুচক্রের প্রতিফলন দেখা যায় নদী, পদ্মফুল ও আকাশের রূপে। মধ্যযুগে এসে বৈষ্ণব পদাবলীতে শরতের রূপ প্রকট। রাধাকৃষ্ণের মিলন-বিরহের আবহে শরৎচাঁদ, শরৎরাত্রি কিংবা শরৎপূর্ণিমা হয়ে ওঠে প্রেমের প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ:
'শরৎচাঁদে রাধার মন কাঁদে'
এটি শুধু প্রকৃতির বর্ণনা নয়, প্রেমবেদনার প্রতীক হিসেবে বাংলার পাঠকের চেতনায় স্থায়ী হয়েছে।
([সূত্রঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শর্মিষ্ঠা; বৈষ্ণব পদাবলী, ১৫-১৭শ শতাব্দী])
শরৎ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক প্রকাশঃ
রবীন্দ্রনাথের কাছে শরৎ কেবল প্রকৃতি নয়, মানবমনের আশ্বাস ও পুনর্জন্মের প্রতীক। তাঁর কালান্তর কাব্যে লেখা-
'আকাশ ভরা সূর্যমুখী ফুলে,
আকাশ ভরা কালো মেঘের দলে-
শরৎ এসেছে, দাও শরৎ-আশ্বাস।'
-এখানে বর্ষার বিষণ্নতার পরে শরৎ মানব জীবনে নতুন আশ্বাসের প্রতীক। শেষের কবিতা উপন্যাসে শরতের কাশফুল প্রেমের আবহ গড়ে তোলে, আর কালান্তর প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন-
'বর্ষার বিষণ্নতা শেষে শরৎ হলো নতুন আশ্বাসের ভাষা।'
রবীন্দ্রনাথ শরৎকে কেবল ঋতুচিত্রে আবদ্ধ করেননি; তিনি এটিকে সামাজিক-মানসিক পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করেছেন।
([সূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালান্তর, বিশ্বভারতী, ১৯৩০; শেষের কবিতা, বিশ্বভারতী, ১৯৩৫])
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শরতের নিস্তব্ধতা ও স্মৃতিঃ
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শরৎ পাওয়া যায় স্তিমিত স্মৃতি ও নিস্তব্ধতার রূপক হিসেবে। বনলতা সেন-এ তিনি লিখেছেন-
'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-
এই বাংলার কাশবনে ধূসর শরতের ভোরে।'
-শরৎ এখানে মৃত্যু ও স্মৃতির মিলন, নিস্তব্ধতা এবং একাকিত্বের প্রতীক। ঝরা পালক, মাটির প্রতি চিরফেরার আকাঙ্ক্ষা—এগুলো শরতের নিস্তব্ধ দৃষ্টিকোণকে আরও গভীর করেছে।
([সূত্রঃ জীবনানন্দ দাশ, বনলতা সেন, সিগনেট প্রেস, ১৯৪২; ঝরা পালক, ১৯২৭])
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কলমে শ্রমমুখী শরৎঃ
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে শরৎ মানে কৃষকের ঘামে ভেজা মাঠ, ধান পাকা, ফসলের গান। ছাড়পত্র কাব্যে তিনি লিখেছেন-
'শরৎ মানে ধান পাকা, শরৎ মানে ফসলের গান।'
এখানে শরৎ শুধু সৌন্দর্যের নয়, বরং শ্রম ও সংগ্রামের প্রতীক। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ প্রাসঙ্গিক।
([সূত্রঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য, ছাড়পত্র, নবযুগ প্রকাশনী, ১৯৪৭])
জসীমউদ্দীন ও আল মাহমুদের কবিতায় গ্রামীণ এবং প্রেমবেদনার শরৎঃ
জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ-এ শরৎ গ্রামীণ জীবনের আনন্দ ও গানকে তুলে ধরে-
'ধানের ক্ষেতে কাশফুল দোলে, শরৎ এল গ্রামবাংলায়।'
-এখানে শরৎ গ্রামীণ সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ আনন্দের প্রতীক।
([সূত্রঃ জসীমউদ্দীন, নকশী কাঁথার মাঠ, ১৯২৯])
আল মাহমুদ সোনালি কাবিন-এ শরৎ এসেছে প্রেম ও বেদনার সংমিশ্রণে-
'শরৎরাতে কাশফুলের পাশে দাঁড়িয়ে
তোমার শাড়ির আঁচলে যে সাদা গন্ধ পেয়েছিলাম।'
এখানে শরৎ ব্যক্তিগত আবেগ এবং অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রতীক।
([সূত্রঃ আল মাহমুদ, সোনালী কাবিন, ১৯৭৩])
উপন্যাস, নাটক ও গদ্যে শরতের উপস্থিতিঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীকান্ত-এ নদীর ধারে সন্ধ্যা শরতের স্বপ্নময় আবহ গড়ে তোলে।বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পথের পাঁচালী ও আরণ্যক-এ শরতের প্রকৃতি গ্রামীণ বাস্তবতা ও একাকিত্বের সংমিশ্রণ।হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি বিলাস, গোধূলি লগ্নে-তে শহুরে জীবনের নিঃসঙ্গ শরৎচিত্র ফুটে উঠেছে।নাটক ও প্রবন্ধেও শরৎ মানুষের অন্তর ও প্রকৃতির সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছে, যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্তের শর্মিষ্ঠা।
([সূত্রঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পথের পাঁচালী, ১৯২৯; মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শর্মিষ্ঠা])
বিশ্বসাহিত্যে শরৎ ও তুলনাঃ
জন কিটসের Ode to Autumn-এ শরৎ হলো ‘mellow fruitfulness’-এর ঋতু, অর্থাৎ ফসল ও পরিপক্বতার সময়। জাপানি হাইকুতে শরৎ চাঁদ, ঝরা পাতা ও একাকিত্বের প্রতীক।
বাংলা সাহিত্যে শরৎ তুলনামূলকভাবে বহুমাত্রিক-সৌন্দর্যের পাশাপাশি শ্রম, সংগ্রাম, প্রেম-বিরহ ও স্মৃতির অন্তর্লোক যুক্ত।
সূত্র: John Keats, Ode to Autumn; Various Japanese Haiku Anthologies])
সমকালীন প্রেক্ষাপটঃ
আজকের শহুরে জীবনে শরতের প্রকৃতিবর্ণনা সরাসরি ধরা পড়ে না। মেট্রোরেল, যানজট, কংক্রিটের জঙ্গল ঋতুর রূপকল্পকে ম্লান করছে। তবু কবি-লেখকরা শরৎকে নতুন ব্যাখ্যায় হাজির করছেন- কখনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রতীক, কখনো ডিজিটাল জীবনের ভিড়ে হারানো নৈঃশব্দ্যের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে। সাংবাদিকতার ভাষায় বলতে গেলে, শরৎ আমাদের সাংস্কৃতিক আর্কাইভে কেবল কবিতার বিষয় নয়, একটি সামাজিক চেতনার ক্ষেত্র।
অবলোকনঃ বাংলা সাহিত্যে শরৎকাল কখনো প্রেমের, কখনো বিরহের, কখনো কৃষিশ্রমের, কখনো আবার নিস্তব্ধ স্মৃতির প্রতীক। প্রাচীন পদ থেকে আধুনিক উপন্যাস পর্যন্ত শরতের যে বহুমাত্রিক উপস্থিতি আমরা দেখি, তা প্রমাণ করে-শরৎ কেবল ঋতু নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক প্রতীক।
আজকের পাঠকের কাছে প্রশ্ন জাগে- আমরা কি আবারও কাশবনের সেই ধূসর শরতের ভোরে ফিরে যেতে চাই, নাকি শহুরে ব্যস্ততায় ঋতুচক্রকে কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় সীমাবদ্ধ রাখব? উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরতে হবে সাহিত্যেই -যেখানে শরৎ চিরকাল আশ্বাস, প্রেম ও জীবনের অমোঘ প্রতীক হয়ে থাকবে।
সূত্রসমূহঃ
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালান্তর, বিশ্বভারতী, ১৯৩০
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শেষের কবিতা, বিশ্বভারতী, ১৯৩৫
৩. জীবনানন্দ দাশ, বনলতা সেন, সিগনেট প্রেস, ১৯৪২
৪. জীবনানন্দ দাশ, ঝরা পালক, ১৯২৭
৫. সুকান্ত ভট্টাচার্য, ছাড়পত্র, নবযুগ প্রকাশনী, ১৯৪৭
৬. জসীমউদ্দীন, নকশী কাঁথার মাঠ, ১৯২৯
৭. আল মাহমুদ, সোনালী কাবিন, ১৯৭৩
৮. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত
৯. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পথের পাঁচালী, ১৯২৯
১০. মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শর্মিষ্ঠা
১১. John Keats, Ode to Autumn
১১. Various Japanese Haiku Anthologies
লেখকঃ কবি,প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।
আপনার মতামত লিখুন :