নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৯ বছরেও নেই ডে কেয়ার সেন্টার

আলমগীর হোসেন , নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ০৫ অক্টোবর, ২০২৫, ০৭:০৬ পিএম

প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর হলেও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোনো ডে কেয়ার সেন্টার। ফলে মা শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে কঠিন পরিস্থিতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৯৪ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে ৪০ বা তার বেশি নারী কর্মী থাকলে ছয় বছরের নিচের শিশুদের জন্য একটি শিশু যত্নকক্ষ থাকতে হবে। অর্থাৎ আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠানে ডে কেয়ার সেন্টার থাকা বাধ্যতামূলক।  আইন অনুযায়ী, ডে কেয়ার সেন্টার না থাকা মানে আইনের পরিপন্থী।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন (৪৯ তম বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২) অনুযায়ী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২৮৯ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮৬ জন নারী শিক্ষক ও মোট ৬৫৮৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০০৩ জন নারী শিক্ষার্থী রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, এই বিপুল সংখ্যক নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে নেই কোনো ডে কেয়ার সেন্টার।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূর জাহান বেগম ৫ আগস্ট ২০২৫ (সোমবার) বাংলাদেশে শিশুর স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসম্মত বিকাশ নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে শিশুর দিবাযত্ন (ডে-কেয়ার) কেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দিলেও ডে কেয়ার স্থাপনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে পাঠদান, গবেষণা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব একসাথে সামলাতে হয়। মা হওয়ার পর যুক্ত হয় সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা। কিন্তু ডে কেয়ার সেন্টারের অভাবে অনেক মা শিক্ষককে সন্তানের নিরাপত্তার জন্য বাড়ি-পরিবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান এমন ঘটনা। বাসায় পরিবারের কোনো সদস্য, প্রতিবেশী বা কাজের লোকের কাছে সন্তানকে রেখে সারাদিনের জন্য চলে আসতে হয় কর্মক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে এসে একজন মা যদি সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, তবে তার মেধা ও শ্রমের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয় না। ফলে ব্যাহত হয় মনোযোগ; যা শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলে।

মা শিক্ষার্থীরাও এই সমস্যার সম্মুখীন হন। ডে কেয়ার সেন্টারের অভাবে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মা শিক্ষার্থীকে ক্লাস, পরীক্ষায় উপস্থিত হতে হয়। অনেক সময় পড়াশোনায় বিরতি বা ইয়ার গ্যাপ নিতে বাধ্য হতে হয়। কখনো কখনো পড়ালেখা থেকে ছিটকেও পড়তে হয়।

এসম্পর্কে স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের স্নাতক ২০২০-২১  শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শর্মিষ্ঠা ইসলাম বলেন, "আমি ৩য় বর্ষে থাকাকালীন আমার বাচ্চা হয়। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত সংগ্রাম করেই যাচ্ছি।  কখনো বাচ্চাকে সাথে নিয়ে, আবার কখনো বাচ্চাকে বাসায় রেখে আসতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাঝে মাঝে বাচ্চাকে নিয়ে খুবই অসহায় লাগে। আশেপাশের মানুষ সবসময় যে সহযোগিতা করে বেপারটা সেরকম নয়। তখন একজন মা হিসেবে খুবই নিরুপায় লাগে। ডে কেয়ার সেন্টার থাকলে আমি কিছুটা স্বস্তি পেতাম।"

একই বিভাগের স্নাতক ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিয়া তাহসিন তিন্নি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী কর্মী ও শিক্ষার্থীদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার থাকা অত্যন্ত অপরিহার্য। আমি ২০২২ সালে মা হয়েছি। মা হওয়ার পর ক্লাস ও পরীক্ষায় আমাকে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। ছোট বাচ্চাকে বাসায় রেখে ক্লাস ও পরীক্ষায় আসতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডে কেয়ার সেন্টার থাকলে আমি উপকৃত হতাম। সন্তানের নিরাপত্তা ও সঠিক যত্ন নিশ্চিত হলে আমি পড়ালেখায় আরও ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পারতাম।”

উইমেন পিস ক্যাফের (বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিয়ে কাজ করে যাওয়া ক্রিয়াশীল সংগঠন) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইশরাক জাহান বলেন, "আমাদের একজন সহপাঠী সন্তানের চিন্তায় প্রায়ই ক্লাস মিস করতে বাধ্য হয়। যদিও তার সন্তানের দেখাশোনার জন্য একজন গৃহকর্মী আছে, তবুও সন্তানের প্রতি সঠিক যত্ন ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে সে শঙ্কিত থাকে। একই সংশয়ে ভুগছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ও কর্মরত অনেক নারী। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে একটি আধুনিক ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হলে শুধু তাদের ভোগান্তি কমবেই না, বরং তারা আরও বেশি দক্ষতা ও উদ্যম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করতে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন।"

স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফরোজা ইসলাম লিপি বলেন, “আমি মা হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডে কেয়ার সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। কিছুদিন আগে আমার ২য় সন্তান জন্ম নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের জন্য নিরাপদ ও সুষ্ঠু শিশু যত্নের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক বলে আমি মনে করি। ডে কেয়ার সেন্টার না থাকা বাংলাদেশ শ্রম আইন পরিপন্থী। এটি শুধুমাত্র আইনের কথা নয়, বরং নারী শিক্ষার্থীর ও শিক্ষকের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা দপ্তরের সহকারী পরিচালক কাউন্সিলিং (সাইকোলজিস্ট) মোছা. আদিবা আক্তার বলেন, "ডে কেয়ার সেন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি পিতামাতার চাপ ও কর্মক্ষেত্রের চাপ কমানো, কর্মজীবনের ভারসাম্য রক্ষা, নিজের যত্ন নেয়া, কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা ও সন্তুষ্টি বৃদ্ধি, এবং সেই সাথে শিশুর সঠিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সময়ে  কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাবা-মা দুজনই চাকরি করেন এমন পরিবারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও সময়ের পরিক্রমায় নানাকারনে আমাদের দেশে ছোট পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে তাতে করে বাবা-মায়ের বিশেষ করে মায়েদের মানসিক চাপ অনেক বেশি বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভালো মানের ডে-কেয়ার সেন্টার শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে যথাযথ যত্নের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র ও সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে ভারসাম্য বজায় রাখতে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষার্থী তথা সকলের জন্য সহায়ক হতে পারে।"

নিবন্ধন সনদ ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা যাবে উল্লেখ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মনির আলম বলেন, "আন্তজার্তিক মানবাধিকার আইন ও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ অনুসারে শিশুদের বিশেষ সুরক্ষা, যত্ন এবং সহায়তা পাওয়ার সহজাত অধিকার আছে। শিশুদের এই অধিকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে শিশু আইন নামে একটি আইনও প্রণয়ন করা হয়। শ্রম আইন, ২০০৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও ডে কেয়ার এর ধারণাটা মূলত এই আইনের ৯৪ ধারায় অন্তর্নিহিত আছে। ডে কেয়ার সংক্রান্ত  শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র আইন, ২০২১ ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বিধিমালা ২০২২ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব  ব্যবস্থাপনায়, নির্ধারিত শ্রেণির কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সেহেতু ডে কেয়ার স্থাপনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো নিবন্ধন সনদ নেওয়াটাও বাধ্যতামূলক নয়। সুতরাং খুব সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় একটি কমিটি গঠন করে ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নিতে পারেন।"

স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সাদিক হাসান শুভ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ইতোমধ্যে আমরা বিভাগে মেয়েদের জন্য একটি কমন রুম স্থাপন করেছি। কমনরুমে মেয়েরা বিশ্রাম নিতে পারে। নামাজ পড়তে পারে। কমনরুমের মিরর দেখে তারা পরিপাটিও হতে পারে। তবে এখনো শিশুদের দেখাশোনার সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। যদি ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে মা শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিশ্চিন্ত মনে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এতে প্রশাসনও তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা ও আউটপুট পাবে। একই সঙ্গে শিশুদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, "ডে কেয়ার সেন্টার স্থাপন জরুরি। তবে আমাদের ক্যাম্পাসে এখন পর্যন্ত এব্যাপারে কোনো উদ্যোগ এখনো গ্রহণ করা হয়নি। আমরা ডে কেয়ার সেন্টার নিয়ে স্থাপন নিয়ে কাজ করবো।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবার সাথে আলোচনা করি দেখি কিভাবে করা যায়।"

Link copied!