দক্ষিণাঞ্চলীয় জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার একমাত্র সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র—পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এখানকার চিত্র এখন চরম অব্যবস্থাপনা ও সংকটে ভরপুর। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স, সহায়ক ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী না থাকায় প্রতিদিন শত শত রোগী সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
হাসপাতালটির অবস্থা এতটাই নাজুক যে মৃত্যুর পরও কোনো রোগীকে আনুষ্ঠানিকভাবে “মৃত ঘোষণা” করা যায় না—কারণ এখানে নেই ইসিজি (Electrocardiogram) ও অন্যান্য জীবন নির্ণায়ক যন্ত্রপাতি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নীল রতন সরকার।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের একমাত্র ইসিজি মেশিনটি কয়েক বছর ধরে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। এতে কোনো রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে বা হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হতে পারেন না রোগী জীবিত না মৃত। বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনদের স্থানীয় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ইসিজি মেশিন এনে পরীক্ষা করতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয়, পাশাপাশি বাড়ে খরচ ও মানসিক যন্ত্রণা।
পাথরঘাটার স্থানীয় বাসিন্দা মাইনুল ইসলাম সোহেল জানান, সম্প্রতি এক নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। দীর্ঘক্ষণ পর বাইরে থেকে ইসিজি মেশিন এনে নিশ্চিত করা হয় নারীর মৃত্যু হয়েছে।”
পাথরঘাটা পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী আব্দুল্লাহ্ আল মামুন প্রতিদিনের কাগজকে জানান, “একবিংশ শতাব্দীতে এসে যদি উপজেলা হাসপাতালে মৃত ঘোষণা দিতেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রের উপর নির্ভর করতে হয়—তাহলে এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।”
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক মেডিকেল কর্মকর্তা প্রতিদিনের কাগজকে জানান , “আমরা সরকারি হাসপাতালে থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যন্ত্র এনে রোগী পরীক্ষা করি—এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বহুবার জানিয়েছি। এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি।”
জানা যায়, হাসপাতালটির অনুমোদিত জনবল কাঠামো অনুযায়ী ২০৭ জনের পদ থাকলেও ১১৪ টি পদ খালি। এর মধ্যে ৩১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। যারা আছেন তাদেরও অনেকে ছুটিতে বা প্রশিক্ষণে থাকেন, ফলে প্রতিদিনের ডিউটিতে উপস্থিত থাকেন ২-৩ জন চিকিৎসক। একইভাবে ৩৬ জন নার্সের স্থলে কর্মরত আছেন মাত্র ২২ জন, আর সহকারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিলিয়ে জনবল অর্ধেকেরও কম।
মঙ্গলবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স শুধু চিকিৎসা সংকট নয়, অবকাঠামোগত দিক থেকেও পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থা করুণ। রোগী ও স্বজনদের জন্য থাকা বাথরুমে দরজা নেই, পানির সরবরাহ অপ্রতুল, আর স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভাঙাচোরা। নারী রোগীদের জন্য আলাদা টয়লেট থাকলেও তা ব্যবহার অনুপযোগী। এমনকি ভিআইপি কেবিনের বাথরুমের অবস্থাও বেহাল। অপরদিকে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে ৬০ থেকে ৭০ জন।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা আবু হানিফ নামে এক রোগীর স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এখানে চিকিৎসা নিতে আসলে মনে হয় সরকারি হাসপাতাল নয়, জরাজীর্ণ কোনো পরিত্যক্ত ভবন। ডাক্তার পাওয়া যায় না, টয়লেটে দরজা নেই, রোগীরা গরমে কষ্টে ছটফট করে।”
জানা যায়, ইসিজি ছাড়াও হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বিকল রয়েছে। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের বলা হয় বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে। তাতে হাসপাতালের কিছু অসাধু স্টাফদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এতে করে রোগীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা নিম্নআয়ের মানুষের জন্য চরম কষ্টদায়ক।
এবিষয়ে জানতে চাইলে আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ পরিদর্শক দুলালী দেবী ব্যাপারীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার রুমের দরজা তালা বদ্ধ ছিলো।
পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ল্যাব টেকনোলোজিস্ট মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন প্রতিদিনের কাগজকে জানান, “আমাদের হাতে থাকা যন্ত্রপাতির অনেকগুলোই পুরনো ও বিকল। নতুন সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। ফলে অনেক পরীক্ষা হাসপাতালের ভিতরে করা সম্ভব হয় না।”
এ বিষয়ে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) নীল রতন সরকার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, দীর্ঘ বছর ধরেই পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থা বেহাল। আমি কয়েক মাস আগে এখানে যোগদান করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি।
তিনি জানান, "আমি অফিসিয়াল কাজের মধ্যেও জরুরী বিভাগ, বহিঃবিভাগ, আনঃবিভাগ সামলাচ্ছি।" তিনি আরো বলেন, "শুধু ডাক্তার ও নার্স সংকট নয় এখানে কোন পরিচ্ছন্নতা কর্মীও নেই। বাহির থেকে লোক নিয়োগ দিয়ে কাজ করাচ্ছি। ইতোমধ্যে ইসিজি মেশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি মেরামত বা সরবরাহের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কয়েক বার লিখিতভাবে জানিয়েছি। জনবল সংকটের বিষয়টিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সমাধান আসবে।”
এদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল বলছেন, পাথরঘাটা উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষের একমাত্র ভরসা এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এখানে চিকিৎসা সেবার এমন বিপর্যয় অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য। তারা দ্রুত হাসপাতালের সংস্কার, নতুন ইসিজি মেশিন সরবরাহ, পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয়রা মনে করেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এ হাসপাতালের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :