সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন
খায়রুল আলম রফিক : ওদের জন্মই অন্ধকার গলিতে। বেড়ে ওঠে অন্ধকার জীবন নিয়ে। অন্ধকার গলির অন্ধকার জীবনের গল্পটা শুধুই অন্ধকার। বলছি ময়মনসিংহ যৌন পল্লীর শিশুদের কথা। যে বয়সে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার কথা, হাতে থাকার কথা বই ঠিক সেই সময়ে ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে মাদকের মতো ভয়াবহ মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে দেশের বৃহত্তম ময়মনসিংহ যৌন পল্লীর শিশুরা।
অভিভাবক থাকার পরেও যেন অভিভাবক নেই তাদের। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জানা থাকলেও অদৃশ্য কারণে তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ময়মনসিংহ শহরের গাঙ্গিনাপাড়ে উপস্থিত যৌনপল্লীতে বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোররা মাদক ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া বেশির ভাগ শিশু-কিশোররাই বর্তমানে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।
এছাড়া চুরি, ছিনতাই, নারী পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। বাইরের প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারীরা তাদের এ ব্যবসায় নামিয়ে নিজেরা ফায়দা লুটছে বলেও একাধিক সূত্রে জানা যায়। যৌন পল্লীর ভিতরে বর্তমানে প্রায় কয়েকটি মদের দোকান, প্রায় ৭টি গাঁজার দোকান ও ভাসমান হেরোইন, ফেনসিডিল ব্যবসায়ী প্রশাসনের চোখের সামনেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যবসা। কামিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
পাশাপাশি অনেক প্রভাবশালী বাড়িওয়ালারাও মাদক বাণিজ্যে পল্লীর শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিদিন সড়ক ও রেলপথে নানা ধরনের মাদক দ্রব্য যৌনপল্লীতে চলে আসে। এর বাইরে স্থানীয় সরকারি লাইসেন্সধারী মদের ডিলার হিসেবের মারপ্যাঁচে প্রতিদিন শত শত লিটার মদ যৌনপল্লীতে সরবরাহ করছে।
প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ব্যবসা চললেও অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি তাদের নজরে আসছে না। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েক নেতা ও পুলিশের অসৎ কয়েক কর্মকর্তা এ ব্যবসা থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকার মাসোহারা আদায় করছে।
আর এভাবে বৈধ দোকানে অবৈধ মদ সরবরাহের কারণে পল্লীর ভেতরে অন্তত্য শতাধিক শিশু-কিশোর মাদক সেবন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। যৌনপল্লীর নারী ও শিশুদের নিয়ে কর্মকর্তারা বলেন, যৌনপল্লীর এই অন্ধকার পরিবেশে একটি সুস্থ্য শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ও মেধাবিকাশ স্বপ্নহীন মাত্র। তবে আমরা যৌনপল্লীর এ অবহেলিত শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য নিয়মিত তাদের শিক্ষা বিকাশ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, নৈতিক শিক্ষা, সঞ্চয়, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানসহ নানা ধরনের কাজ করে আসছি।
এরই মধ্যে পল্লীর অনেক শিশু-কিশোরকে হাতে-কলমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং বর্তমানে তারা স্বাভাবিক ও সুস্থ্যভাবে জীবন কাটাচ্ছে। ময়মনসিংহে বাড়ছে শিশু যৌনকর্মীর সংখ্যা ময়মনসিংহ যৌনকর্মীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পল্লীর প্রভাবশালী বাড়িওয়ালীদের ছত্রছায়ায় এখানে গড়ে উঠেছে এক শ্রেণীর দালাল চক্র। চক্রটি আইনের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ মেয়ে শিশুদেরকে নানাভাবে ফুঁসলিয়ে যৌনপল্লিতে নিয়ে আসে। ময়মনসিংহের বাইরে থেকে এসে খদ্দেররাও রাত যাপন করেন। নিশি রাতে তাদের করা হয় ব্ল্যাকমেইল। রাত যাপনের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে পরিবারকে দেখাবে বলেও হুমকি দিয়ে মোটামুটি টাকা আদায় করা হয়। অনেকেই লজ্জায় মুখ খুলতে নারাজ। একাধিক ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলেন।
অনেক অপ্রাপ্ত বয়সের সুন্দরী তরুণীদের মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দেয় তাদের। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো শিশু-কিশোরীকে যৌন পেশায় বাধ্য করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বিষয়টি নজরে আসছে না স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার।
এ পল্লীতে বর্তমানে প্রায় ৮০০ শত যৌনকর্মীর বসবাস। এর মধ্যে ৭৭ জন শিশু-কিশোরী যৌনকর্মীও রয়েছে। পতিতা-পল্লীর এক মুদি দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখানে অনেক প্রভাবশালী যৌনকর্মী রয়েছে যারা পল্লীর বাইরে ময়মনসিংহ শহরসহ বিভিন্ন গ্রামে নিজস্ব বাড়িঘর তৈরি করে সেখানে নিয়মিত বসবাস করছে।
একই সঙ্গে নারীপাচার কাজেও তারা ওই বাড়িগুলোকে ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে দালালের মাধ্যমে ফুঁসলিয়ে আনা নতুন কোনো মেয়েকে সরাসরি পতিতা-পল্লীতে না এনে প্রথমে তাকে পল্লীর বাইরে ওই সব বাড়িতে রাখা হয়। সেখানে দুই-তিন দিন ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখার পর সুযোগ বুঝে সংশ্লিষ্ট যৌনকর্মী মেয়েটিকে পতিতা-পল্লিতে নিয়ে তাকে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দেয়। তিনি আরো জানান, দালালের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ৩৫ জন নতুন শিশু-কিশোরীকে এই পল্লিতে আনা হয়। পরে বাড়িওয়ালিরা তাদের জোর করে যৌন পেশায় বাধ্য করে।
যৌনকর্মী (ছদ্মনাম) আকলিমা বলেন, চার বছর আগে আমার বয়স যখন ১৩, তখন দালালের খপ্পরে পড়ে আমি রংপুর থেকে ভালুকা হয়ে এই পল্লিতে আসি। তখন নগদ ৫০ হাজার টাকায় ওরা আমাকে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে খারাপ কাজে রাজি না হওয়ায় বাড়িওয়ালি আমাকে মারপিটসহ অমানুষিক নির্যাতন চালায়। দিনের পর দিন ওরা আমাকে না খাইয়ে রেখেছে। এক মুঠো ভাতের জন্য তখন তাদের পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছি।
তাতেও মন গলেনি ওদের। শারীরিক নির্যাতন ও ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে একপর্যায়ে এ পথে নামতে বাধ্য হয়েছি। তিনি আরো জানান, বর্তমানে এ পল্লিতে তাঁর মতো অনেক শিশু-কিশোরী রয়েছে। যাদের মনে জমে থাকা কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় না। পল্লির যৌনকর্মী নাসরিন জানান, পতিতা-পল্লিকে ঘিরে এখানে যে পরিমাণ এনজিও গড়ে উঠেছে ওই সব এনজিও যদি তাদের নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তবে এ পল্লিতে শিশুযৌনকর্মীর সংখ্যা অনেক কমে যেত। অথচ এ পল্লিতে শিশু যৌনকর্মীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ময়মনসিংহে মাসে ৩০টি শিশু যৌন পেশায় জড়িত হচ্ছে।