শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন

আপডেট
ফুলবাড়িয়ায় অতিরিক্ত ডিআইজির সম্পদের পাহাড়

ফুলবাড়িয়ায় অতিরিক্ত ডিআইজির সম্পদের পাহাড়

আসাদুজ্জামান তুহিন, ফুলবাড়িয়া থেকে ফিরে: শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল। অতিরিক্ত ডিআইজি। তিনি পুলিশে চাকরি পাওয়ার পর ফুলে ফেঁপে ওঠে সম্পত্তি। তিনি ১৯ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিলেও প্রিলিমিনারি পাস করতে পারেননি। এরপর ২০ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরিতে যোগদান করেন পুলিশে। তিনি এখন শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে ।

গোপালগঞ্জ সদরের পাইককান্দি গ্রামে গিয়ে একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানাগেছে। ২০০৪ সালে জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি সনদটি বাতিল করলেও পুনরায় সনদ বহাল করা হয় বলে তথ্যে উঠে আসে। পুলিশে কর্মজীবন শুরুর পর নিজের নামসহ স্ত্রী ও নিকট আত্মীয়দের নামে দেশে ও বিদেশে শত শত কোটির অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।

 

এ নিয়ে ২০১৪ সালে অভিযোগের পর শিমুলের নামে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। রফিকুল ইসলাম শিমুলকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। ওই সময় কমপক্ষে ৩৫০ কোটি টাকার মালিক শিমুলকে দুদক দায়মুক্তি দেয়। তৎকালীন এসপি রফিকের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অবৈধ অর্থ ক্ষমতা দিয়ে পার পেয়ে যান।

এদিকে রফিকুল ইসলাম শিমুলের অঢেল সম্পত্তির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) বেশ কয়েকবার অভিযোগ করলেও অজানা কারণে এর তদন্ত হচ্ছে না। দুদক কী কারণে শিমুলের অঢেল সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত করছে না বা ব্যবস্থা নিচ্ছে না তা জানেন না অভিযোগকারীরা। ফলে রফিকুল ইসলাম শিমুল বেপরোয়া ক্ষমতাশালী হচ্ছেন এবং সাধারণ মানুষের ওপর তা প্রয়োগ করছেন। শুধু দুদক নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমনকি পুলিশ সদর দফতরে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে তার ক্ষমতার কাছে নির্যাতিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশেষে দুদকের টনক নড়েছে।

 

শিমুলের সম্পত্তির হিসেবের বিষয়ে দুদক আইজিপি বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠিতে শিমুলকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়েও বলা আছে। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল গোপালগঞ্জ শহরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা পাইক কান্দিতে একটি বাংলো বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যেখানে কমপক্ষে তিনি ১০-১৫ কোটি টাকা খরচ করেছেন।
ওই বাড়িতে কেউ থাকেন না। বছরে দুই একবার গেলে ওই বাংলো বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের হাট বসে।

রাজকীয় স্টাইলে ওই বাংলোটি করা হয়েছে। বাংলোর চারদিকে বাগান, মাঠ, পুকুর সবকিছুই রয়েছে। বাড়িটি দুই তলা দেখা গেলেও আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও দুই তলা করা হয়েছে। ভেতরের টাইলস আর অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিদেশি দামি ব্রান্ডের ব্যবহার করা হয়েছে। এলাকার লোকজন বাংলো বাড়িটি দেখতে ভীড় জমান। কেউ ওই এলাকায় ঘুরতে এলেও বাংলোটি দেখতে আসেন।

ময়মনসিংহে জমি, প্লট ও ব্যবসা:
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার নাবি বহর মৌজায় (দাগ নম্বর-৮০/৮৭৭, ৮৭৮, ৮৭৯ ও ৮৮৩) জমির পরিমাণ ৭৮ শতাংশ জমি রয়েছে। মাথাজুড়ি মৌজার ছলংগায় ১২ বিঘা জমি। একই মৌজায় অন্য দাগে ২০ শতাংশ। মাথাজুড়ি বাজার সংলগ্ন ২১২১ নম্বর দাগে ১০০ শতাংশ, ২২৪১ নম্বর দাগে ১৪২ শতাংশ, ও ২৪৭৩ নম্বর দাগে ১৭৫ শতাংশ জমি রয়েছে। ফুলবাড়িয়া কসাইচালা মৌজায় আছে এক দাগে ২০ বিঘা জমি। ফুলবাড়ি উত্তরপাড়ায় আছে ২৪ শতাংশ জমি। স্ত্রী শিরিন আক্তারের নামে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া কসাইচালা মাথাজুড়ি মৌজার ৩০০৩, ৩০০৪, ৩০১১ ও ২০১২ নম্বর দাগে ৮ বিঘা জমি রয়েছে ।

গোপালগঞ্জে সদর উপজেলার পাইক কান্দি গ্রামে তার জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার মতো। গোপালগঞ্জে আরও জমি কেনা হয়েছে সেগুলো অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের নামে। শ্বশুরের নামে সম্পত্তি, দুদকের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম শিমুল তার শ্বশুর আজিজুল ইসলাম খান ওরফে আজিল খানের নামে ৩০-৩৫ কোটি টাকা দিয়ে দুটি মাঝারি আকারের জাহাজ কিনে দিয়েছেন। জাহাজ দুটি ঢাকা-চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দর রুটে পণ্য পরিবহন করে। মুন্সীগঞ্জে শ্বশুর, শ্যালিকা ও ভায়রা ভাইয়ের নামে প্রায় ১০০ বিঘা আবাদি জমি কিনেছেন। পুরান ঢাকাতে শ্বশুরের নামে কিনেছেন একাধিক ফ্ল্যাট। বিক্রমপুরে রয়েছে বিভিন্ন রিয়েল স্টেট কোম্পানিতে শেয়ার ও বাণিজ্যিক প্লট।

 

বড় ভাবির নামে সম্পত্তি: অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘উদারমনা’ এই মহান ব্যক্তি সম্পদ করেছেন বড় ভাইয়ের স্ত্রীর নামেও। ধানমন্ডি রোড-৬, ফ্লাট-২৩, ২/ডি নম্বর আধুনিক ফ্ল্যাটটি তার ভাবির নামে কিনেছেন শিমুল। শ্যালক মামুনের নামে যমুনা ফিউচার পার্কে দুটি দোকান দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে— রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়ে দুটি দোকান ক্রয় করা হয়েছে। যার একটি হলো, লেভেল-১ এ ডিসিসি কর্ণার, দোকান নম্বর-১এ-০৫১০।

ভাগ্নি জামাই সেলিমের নামে সম্পত্তি: ভাগ্নি জামাই সেলিমের নামে গোপালগঞ্জ শহরের বেদগ্রাম রেডিও সেন্টার (ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক) সুইমিং ফেডারেশন ট্রেনিং সেন্টারের পুর্ব পাশে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো ১৫৬ শতক জমি রফিকের। ভাগ্নি জামাইয়ের নামে ক্রয় করা হলেও টাকা পরিশোধ করেছেন রফিক। সেখানে গেলে আশেপাশের সকল মানুষ জমিটি রফিকের তা সবাই বলেন। এছাড়া পাইক কান্দি গ্রামে সেলিমের নামে কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন রফিক। এবং একটি আধুনিক বাড়িও তৈরি করে দিয়েছেন।

 

দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, দেশে সম্পতি ছাড়াও ইংল্যান্ড, মালয়শিয়া ও কানাডার টরেন্টোতে বাড়ি সেকেন্ড হোম করেছেন রফিকুল ইসলাম শিমুল। অভিযোগে গত ২০/২২ বছরে কিভাবে একজন এসপি এত সম্পতির মালিক হলেন তা সরেজমিন তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদকের প্রতি অনুরোধ করা হয়।

নরসিংদীর পুলিশ সুপার থাকাবস্থায় তাকে নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়। এরপর তাকে বদলি করে পাবনার পুলিশ সুপার করা হয়। সেখানেও একজন সংসদ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখল করতে যান। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এরপর তিনি পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত হিসেবে থাকেন। সেখান থেকে অ্যাডিশনাল ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পেলে সিটি এসবিতে বদলি করা হয়। এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলামের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |