শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:২৮ অপরাহ্ন

শাহজালাল যেন ‘সোনার খনি !

শাহজালাল যেন ‘সোনার খনি !

খায়রুল আলম রফিক :
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস বিভাগের লকার থেকে ৬১ কেজি সোনা চুরি বা গায়েবের ঘটনা ফাঁস হয়েছে ২০২৪ সালের জানুয়ারীতে। যদিও প্রাথমিক হিসাবে বেহাত হওয়া সোনার পরিমাণ ছিল ৫৫ কেজি। পরিমাণ যাই হোক প্রাথমিকভাবে কাস্টমস বিভাগের নিম্ন স্তরের কিছু কর্মকর্তা চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার হলেও পেছনের রাঘববোয়ালরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতদিন রাঘববোয়ালরা আ,লীগের তোদের ছত্রছায়ায় ছিল। সরকার পতনের পর তারা এখন গাঢাকা দিয়েছে।

যদিও এরই মধ্যে ঢাকা কাস্টম, এনবিআর, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সিআইডি’র পর পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব নিলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে, কাস্টমসের উপরের স্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া দিনের পর দিন এমন অপকর্ম হতে পারে না। এবার সেই আড়ালের খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচনে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের গোয়েন্দা নজরদারিতে বেশকিছু নতুন তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর কমিশনের অনুমোদনক্রমে টিম গঠন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এনবিআর ও ঢাকা কাস্টম হাউসের পৃথক তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন নথিপত্র তলব করা হয় । তাও এখন নিরব । ওই প্রতিবেদন ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করতে চায় সংস্থাটি। এঘটনার সাথে আ,লীগের বড় বড় রাঘববোয়ালরা সরাসরি জড়িত থাকায় বেশি দুরে যায়নি।

এক কর্মকর্তা জানান, যত দূর জানি ৫৫ থেকে ৬২ কেজি সোনা চুরি হওয়া ছাড়াও অন্তত ১০০ কেজির বেশি সোনা লকারে মজুত ছিল। যা ঘটনার পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দেওয়া হয়েছে। তাহলে এত দিন ধরে ১৫০ কেজি সোনা কীভাবে কাস্টমসের লকারে থাকল? কেন নজরদারি ছিল না, কার কার গাফিলতি রয়েছে সবই আমাদের অনুসন্ধানের অংশ। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এর পেছনে কাজ করেছে কি না, সেটাও খুঁজে বের করা হবে বলে জানান। সোনা চুরি হওয়ার দিনটি ছিল শনিবার, সরকারি ছুটির দিন। ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর, রাত ১২টা ১৫ মিনিট থেকে পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে সোনার বার ও স্বর্ণালংকার গোডাউন থেকে স্টিলের আলমারির লকার ভেঙে চুরি হয়। ওই দিনই বিষয়টি জানাজানি হয়। রোববার অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে অফিসিয়ালি ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও গুদামের দায়িত্বে থাকা রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদ রানা শুল্ক বিভাগের একজন যুগ্ম কমিশনারকে গুদামের মূল্যবান পণ্যসামগ্রী রাখার একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙার বিষয়টি অবহিত করেন।

এমন সংবাদ পেয়ে ওই গুদাম পরিদর্শনে যান ঢাকা শুল্ক বিভাগের কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনার। তারা গিয়ে গুদামের একটি স্টিলের আলমারির লকার ভাঙা দেখেন। গুদামের পূর্বপাশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস যে অংশ দিয়ে বের হয়, সেখানকার টিনের কিছুটা অংশ কাটাও দেখতে পান। পরে তারা গুদামের দায়িত্বে থাকা চারজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চারজন সিপাহিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা হলেন- সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদ রানা, সাইফুল ইসলাম শাহেদ, শহিদুল ইসলাম ও আকতার শেখ। চার সিপাহি হলেন- রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, আফজাল হোসেন ও নিয়ামত হাওলাদার।

দুদকের গোয়েন্দা নজরদারিতে বেশকিছু নতুন তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর কমিশনের অনুমোদনক্রমে টিম গঠন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এনবিআর ও ঢাকা কাস্টম হাউসের পৃথক তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন নথিপত্র তলব করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। ওই প্রতিবেদন ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করতে চায় সংস্থাটি
তাদের কাছ থেকে সন্তোষজনক কোনো উত্তর না পেয়ে কী পরিমাণ সোনা ও অন্যান্য পণ্য চুরি হয়েছে তা বের করার জন্য ওই কর্মকর্তারা মৌখিক নির্দেশনা দেন। বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের নিজস্ব গুদামে দিনভর ইনভেনটরি শেষে ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম সোনা চুরি বা বেহাত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পুরো ঘটনা তদন্তের জন্য কাস্টমসের যুগ্ম-কমিশনার মিনহাজ উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম গঠন করে ঢাকা কাস্টম হাউস। যারা ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর এনবিআরের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা কাস্টমসের তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে মিনহাজ উদ্দীন বলেন, ‘ঢাকা কাস্টমস থেকে আমার বদলি হয়েছে। বর্তমানে আমি চট্টগ্রামে কর্মরত। প্রতিবেদন এনবিআরে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে কী আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি এনবিআরে যোগাযোগ করুন, প্লিজ। যা আছে প্রতিবেদনে : বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসের নিজস্ব ইনভেনটরিতে বেহাত হওয়া সোনার পরিমাণ ছিল ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম। তদন্ত প্রতিবেদনে বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ কেজি। ঘটনায় দুজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও একজন সিপাহির দায়িত্ব অবহেলাকে দায়ী করা হয়েছে। তারা হলেন- শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম এবং সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার। তারা ওই গুদামে দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও কাস্টমসের মামলার সূত্র ধরে চার কর্মকর্তাকে ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম সাহেদ, মো. শহীদুল ইসলাম, মাসুম রানা ও আকরাম শেখ।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে সিসি ক্যামেরার স্বল্পতা, নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন না পাওয়া, মজুত হওয়া স্বর্ণ সময় মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে না পাঠানো এবং জনবল সংকটের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। নানা অসংগতি ও গাফিলতির কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে বড় কোনো কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো প্রভাবশালী মহলের কোনো তথ্য ছিল না কাস্টমসের তদন্ত প্রতিবেদনে। যেহেতু সরকারি সম্পদ কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ঘটনা, তাই এটা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। সেই বিবেচনায় দুদক থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও বক্তব্য পাওয়া না গেলেও নাম প্রকাশ না করে কাস্টমসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আসলে এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর সবারই টনক নড়েছে। তবে, গুদাম ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপেই ঘাটতি ছিল। যখন সোনা চুরির ঘটনাটি ঘটে, তখন কোনো নিরীক্ষা কর্মকর্তা ছিল না। অথচ গুদামে একজন নিরীক্ষক থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যিনি প্রতি মাসে নিরীক্ষা প্রতিবেদন কমিশনারের কাছে পেশ করবেন, অন্যদিকে কমিশনার প্রতি ছয় মাসের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এনবিআরে দাখিল করবেন।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত যাত্রীর কাছ থেকে আটক হওয়া সোনা, যেগুলো ফেরতযোগ্য; সেগুলো যথাযথ কারণ দেখিয়ে সর্বোচ্চ ২০-২৫ দিন গুদামে রাখার এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু যেগুলো মামলাসংশ্লিষ্ট কিংবা সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা, ওই সোনা কোনো যুক্তিতেই কাস্টমসের লকারে রাখা যাবে না। অবশ্যই সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দিতে হবে। কিন্তু ঢাকা কাস্টমসের ইনভেনটরিতে দেখা গেছে, চুরি হওয়ার পরও কাস্টমসের লকারে ১০০ কেজির মতো সোনা পাওয়া যায়। যা চুরির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। অর্থাৎ গুদাম ব্যবস্থাপনার প্রতিটি ধাপে গাফিলতি ছিল, এটা নিশ্চিত। শাহজালাল যেন ‘সোনার খনি’, চোরাচালানের এত সোনা যায় কোথায়?
বিদেশ থেকে একজন যাত্রী কতটুকু সোনা আনতে পারেন?

বিমানবন্দরের কাস্টমস লকার থেকে সোনা চুরির ঘটনায় ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। যদিও ওই সময় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে সিসি ক্যামেরার স্বল্পতা, নিয়মিত নিরীক্ষা প্রতিবেদন না পাওয়া, মজুত হওয়া স্বর্ণ সময় মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে না পাঠানো এবং জনবল সংকটের বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। নানা অসংগতি ও গাফিলতির কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে বড় কোনো কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো প্রভাবশালী মহলের কোনো তথ্য ছিল না কাস্টমসের তদন্ত প্রতিবেদনে মামলার এজাহারে বলা হয়, সোনা চুরির বিষয়টি ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস গুদাম কর্মকর্তা মাসুদ রানার নজরে আসে। পরবর্তীতে গুদামে রাখা মূল্যবান বস্তু চুরি হয়েছে কি না, তা যাচাই করা হয়। যাচাইকালে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময় আটক হওয়া ডিএমের (ডিটেনশন মেমো) ৫৫.৫১ কেজি সোনার বার ও অলংকার লকার ভাঙা আলমারিতে পাওয়া যাচ্ছে না। চুরি হওয়া সোনার বর্তমান বাজারমূল্য ৪৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে উদ্ধার হওয়া ৪৮টি ডিএম বার যার ওজন ৮.০২ কেজি এবং ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে আটক ৩৮৯টি ডিএম বার যার মোট ওজন ৪৭.৪৯ কেজি, আলমারির লকার ভেঙে চুরি হয়েছে। সবমিলিয়ে ৫৫ কেজি ৫১ গ্রাম স্বর্ণালংকার পাওয়া যায়নি। ২ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১৫ মিনিট থেকে পরের দিন সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে কে বা কারা বর্ণিত সোনার বার ও স্বর্ণালংকার গোডাউন থেকে স্টিলের আলমারির লকার ভেঙে চুরি করেছে।

ঢাকা কাস্টমসের করা ফৌজদারি মামলাটি প্রথমে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করে। মামলার তদন্তকালে ডিবি মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন- সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, মাসুদ রানা, আকতার শেখ এবং সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার, রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও আফজাল হোসেন। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে গুদামের দায়িত্ব পালন করতেন। বড় অগ্রগতি ছাড়াই মামলাটি ডিবি থেকে গত ২০ সেপ্টেম্বর তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। পিবিআই দায়িত্ব পাওয়ার পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়া দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |