বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৫ অপরাহ্ন
ফয়সাল হাওলাদার:
কৃষির যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খরচ কমাতে ভর্তুকি মূল্যে ধানমাড়াই যন্ত্র (কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন) সরবরাহের উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু সেই ধানমাড়াই যন্ত্র সরবরাহ না করেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। সাবেক সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় মিলেমিশে সরকারি টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করেছেন তারা। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে এমন অনিয়মের চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারের দেয়া ভর্তুকির টাকা উত্তোলনের জন্য উত্থাপিত বিলে প্রকল্প পরিচালকের হয়ে স্বাক্ষর করেছেন একজন অফিস-সহায়ক। সেই স্বাক্ষরেই তিন কোটি আট লাখ টাকার বিল পেয়ে গেছেন প্রকল্পের আওতায় ধানমাড়াই যন্ত্র (কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন) সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি।
তবে, যে ২০টি যন্ত্র সরবরাহের বিপরীতে বিল দেয়া হয়েছে, সেই যন্ত্রগুলো কৃষকপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়নি বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। ঘটনাটি ঘটেছে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা গেছে, ধানমাড়াই যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আদি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির নামে চলতি বছরের মে মাসে বিলটি ছাড় করা হয়। ২০টি কৃষিযন্ত্র সরবরাহের বিপরীতে তিন কোটি আট লাখ ২০ হাজার টাকা বিল করা হয়। সমুদয় অর্থ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করে সরকার। যেসব যন্ত্র সরবরাহের কথা বলা হয়, মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে অন্তত ১৭ জন কৃষক যন্ত্রটি পাননি বা তাদের সঙ্গে যন্ত্র কেনার বিষয়ে কোনো প্রক্রিয়াই সম্পন্ন করা হয়নি। প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হিসেবে ওই সময় দায়িত্বে ছিলেন তারিক মাহমুদুল ইসলাম।
পিডি থেকে সরিয়ে দেয়ার শেষ মুহূর্তে তিনি ঘটনাটি ঘটান। অভিযোগ আছে, তারিক মাহমুদুল যখন পিডি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তখন মূলত অফিসের সবকিছু পরিচালনা করতেন প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক আলতাফুন নাহার ও সহকারী হিসাবরক্ষক মো. আরমান মিয়া। দুজনে মিলে অবৈধভাবে যে টাকা আয় করতেন তার নির্দিষ্ট একটি ভাগ তারিক মাহমুদুলের কাছে পৌঁছে দিতেন। যে কারণে তিনি আলতাফুন নাহার ও আরমান মিয়ার কোনো কাজেই হস্তক্ষেপ করতেন না। এদিকে, আদি এন্টারপ্রাইজের তিন কোটি টাকার বিলটিতে পিডি তারিখ মাহমুদুল ইসলামের স্বাক্ষর থাকার কথা। কিন্তু সেখানে মোহাম্মদ আল রিফাত নামের এক অফিস সহকারীর স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। সেটি হিসাবরক্ষক আরমান মিয়া তাকে দিয়ে জোর করে করিয়েছেন বলে দাবি রিফাতের। তিনি বলেন, ‘বিলটিতে আরমান আমাকে জোর করে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। আমি করতে চাইনি। এ ছাড়া ঘটনাটি যাতে আমি কাউকে না বলি সেজন্য তিনি আমাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আরমান মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘তাকে (মোহাম্মদ আল রিফাত) দিয়ে কেন আমি স্বাক্ষর করাব? এতে আমার কী লাভ? টাকা পেলে তো ওই প্রতিষ্ঠান পাবে। প্রকল্প পরিচালকই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন। আসলেই স্বাক্ষরটি কার— বিষয়টি অনুসন্ধানে তারিখ মাহমুদুল ইসলাম ও আদি এন্টারপ্রাইজের বিলের স্বাক্ষর বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা যায়, দুটা স্বাক্ষরেই পার্থক্য স্পষ্ট। তবে, তারিক মাহমুদুল কিছুতেই স্বীকার করছেন না যে তার স্বাক্ষরটি নকল করা হয়েছে। তার দাবি, ‘স্বাক্ষরটি আমার। প্রতিদিন অনেক স্বাক্ষর করা হয়। যে কারণে একটার সঙ্গে আরেকটার পার্থক্য হতে পারে। প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা যায়, মূলত বিলটির বিপরীতে যে কৃষিযন্ত্রগুলো সরবরাহ করার কথা তা গ্রাহকপর্যায়ে পৌঁছানো হয়নি। ভুয়া বিল তুলে সরকারি ভর্তুকির টাকা প্রকল্প কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানটির (আদি এন্টারপ্রাইজ) লোকজন মেরে দিয়েছেন। শুধু এটাই নয়, যন্ত্র সরবরাহ না করে বিল তুলে নেয়ার এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে। যার মাধ্যমে লাভবান হয়েছেন তারিক মাহমুদুল ইসলাম, আলতাফুন নাহার ও আরমান মিয়ার মতো অসাধু কর্মকর্তারা।
আদি এন্টারপ্রাইজের তিন কোটি টাকার বিলটির বিপরীতে ২০ জন কৃষককে ২০টি যন্ত্র বিতরণ করার কথা। অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ১৭টি যন্ত্র কৃষকের কাছে পৌঁছায়নি। অনেকের এই যন্ত্র নেওয়ার সক্ষমতা নেই। কেউ কেউ আছেন যারা আবেদনই করেননি। বাকি তিনটি যন্ত্রের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, ভুয়া এসব কৃষকের মুখ বন্ধ রাখতে আদি এন্টারপ্রাইজের কিছু কর্মকর্তা ও আরমান মিয়া টাকা বিলিয়েছেন। যেন এ বিষয়ে কেউ অনুসন্ধানে এলে তারা মিথ্যা তথ্য দেন। যেমন- চাঁদপুরের শহরাস্তি উপজেলায় চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক এমরান হোসেন। তার নামে একটি কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ করা হয়েছে। এখানে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ১৫ লাখ টাকার বেশি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি যন্ত্রটি পেয়েছেন কি না। প্রথমে তিনি জানান, কৃষিযন্ত্রটি তিনি পেয়েছেন। পরে ওই এলাকার গ্রামপুলিশ সদস্য মো. কবির হোসেনকে তার বাড়িতে পাঠিয়ে খবর নেওয়া হয়। পরে তিনি জানান, যন্ত্রটি পাননি। কম্বাইন হারভেস্টার নেওয়ার তালিকায় নাম রয়েছে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মুশুরিয়া গ্রামের কৃষক মেহেদী মারুফ রাকিবের। তিনি সরাসরি জানান, তার কাছে এমন কোনো যন্ত্র নেই। তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
এভাবে সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় আদি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আ ক ম সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ‘আমি কিছু বলতে পারব না’ বলে মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। এটি একটি এনজিও। কৃষকদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কাজ করার কথা থাকলেও তাদের সেই অভিজ্ঞতা নেই। তারপরও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিকিৎসক পরিচয়ে এবং সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠজন বিবেচনায় প্রকল্পের শর্ত ভঙ্গ করে যন্ত্র সরবরাহের জন্য আদি এন্টারপ্রাইজের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। মূলত অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মূল উদ্দেশ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির অধীনে আদি এন্টারপ্রাইজ মোট হারভেস্টার যন্ত্র আমদানি করেছে ২১১টি।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ২০২১-২২ অর্থবছরে যন্ত্র সরবরাহ করে বিল নিয়েছে ৬৮টির। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যন্ত্র সরবরাহ করে বিল নিয়েছে ১৮৮টির এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যন্ত্র সরবরাহ করে বিল নিয়েছে ২০৬টির। সবমিলিয়ে মোট ৪৬২টি হারভেস্টারের বিল প্রকল্প দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্থাৎ ২৫১টি যন্ত্রের বিল ভুয়া দেখিয়ে সমুদয় অর্থ তারা হাতিয়ে নিয়েছে। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অডিট হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তদন্ত করছে। অনিয়ম হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নেবে। জানা যায়, গেল সরকারের আমলে কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষির যান্ত্রিকীকরণ এগিয়ে নিতে তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের অধীনে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ক্রয়ে মোট দামের অর্ধেক ভর্তুকি দিত সরকার। হাওরে এটা ৭০ শতাংশ। জাপানি ব্র্যান্ডের একটি মেশিনের দাম ২৮ লাখ টাকা। কৃষক বা এ খাতের উদ্যোক্তারা যন্ত্রটি ক্রয় করলে সরকার ১৪ লাখ টাকা ভর্তুকি দিত। হাওরের কৃষকেরা ভর্তুকি হিসেবে পেতেন ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর চীনা ব্র্যান্ডের একটি হারভেস্টার ২০ লাখ টাকা দিয়ে কিনলে কৃষক ভর্তুকি পেতেন ১০ লাখ টাকা।