শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ অপরাহ্ন
সাঈদুর রহমান রিমন: মাঝে মাঝে কিছু সফল কাজের জন্য আলাদা রকমের সুখবোধ হয়, নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ জানাই। ক্যাসিনো কাণ্ড, মেজর সিনহা হত্যা, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম, সাগর রুনি খুন রহস্য, দেশের অভ্যন্তরে উলফাদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য- ক্যাম্প স্থাপন, পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যুদ্ধের অজানা কাহিনী উদঘাটন, বার্মা লিবারেশন আর্মি প্রধানের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মতো বেশ কিছু বিষয়ে এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন করতে পেরে তেমনি তৃপ্তিবোধ করেছি। ইদানিং আয়না ঘরের বর্বরতা প্রকাশের পর থেকে আবারও আলাদা রকমের সুখ বোধ করছি। কারণ, আজ থেকে সাত বছর আগে ২০১৭ সালে আমার সম্পাদনায় সাফকথা নামের একটি সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন প্রকাশ হতো।
সে সময় গুম শব্দটি লেখার ক্ষেত্রেও নানারকম বিধিনিষেধ ছিল, কোনো পত্রিকায় গুম-অপহরণ নিয়ে লেখালেখি করলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ইউনিটগুলো খুবই বিরাগভাজন হতেন। ক্রাইম রিপোর্টিংয়ে যুক্ত সাংবাদিক বন্ধুরা এটা খুব ভালোভাবেই জানেন। আবার ওই সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিভিন্নজনকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ধরে নেয়ার ব্যাপারে ‘নিখোঁজ’ লিখলেও অপহৃত ব্যক্তির স্বজনরা ক্ষুব্ধ হতেন। তাই অপহরণ করে গুম করে ফেলা মানুষজনের বিষয়টি উল্লেখ করতে আমি ‘উধাও মানুষ’ শব্দ দুটি হেডিংয়ে ব্যবহার করে প্রথম পাতা জুড়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপিয়েছিলাম। বাংলাদেশের মানচিত্রের মধ্যে গুম হওয়াদের ছবি বসিয়ে তৈরি করা প্রচ্ছদ প্রতিবেদনযুক্ত পত্রিকাটি হটকেক হয়ে উঠে এবং প্রথম দিনেই সকল কপি বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় কোনো সংস্করণ ছাপানোর কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি আমাকে।
এ সংস্থা ও সংস্থায় হাজিরা দিতে দিতেই আমার ছয় দিন পেরিয়ে যায়, তাছাড়া সাহসও পাইনি আর। কারণ, বিপাকেপড়া অবস্থায় সরকারের দালাল সাংবাদিকদেরও বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জোটেনি, উল্টো তারা দেশ ছেড়ে দু‘ চার মাস বিদেশে কাটানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। প্রতিবেদনটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করলেই দেখতে পাবেন আজ আয়না ঘর বলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া গুপ্ত বন্দীশালার বিষয়টি তখনই তুলে ধরা হয়েছিল। এর পাঁচ বছর পর ২০২২ সালে তাসনীম এ খলিল আয়না ঘর নিয়ে প্রথম বিস্তৃত অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তারও দুই বছর পর সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে আয়না ঘরের কুৎসিত চেহারা। আসলে একজন সাংবাদিকের সদিচ্ছা থাকলে তিনি নানা কৌশলেই ভয়ঙ্কর সত্যটি প্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করি আমি। চরম বিপজ্জনক সময়েও আমি যে কৌশলেই হোক নিচের লেখাগুলো প্রকাশ করেছিলাম- এটাই আমার স্বার্থকতা, এটাই সাংবাদিকতার সফলতা।
প্রতিবেদনের আংশিক তুলে ধরা হলো ———– “অপহরণ করে আটককৃতদের অত্যন্ত সুরক্ষিত গুপ্ত কোনো স্থানে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের উপর এতো বেশি নির্যাতন চালানো হয় যে, ছাড়া পাওয়ার কয়েক বছর পরেও তাদের মন থেকে আতঙ্ক কাটছেই না। আদিলুর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের একজন অনুসন্ধান কর্মি জানিয়েছেন, গুম থেকে ফিরে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অল্প কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। এতে ধারণা করা হয়, মাটির নিচে কোথাও গুপ্ত বন্দীশালায় তাদের আটকে রাখা হতো। সেখানে মাসের পর মাস তারা কোনো আলো দেখতে পাননি এমনকি বাইরের কোনরকম শব্দও শুনতে পেতেন না।
উদ্ধারপ্রাপ্ত আরেকজনের উদ্বৃতি দিয়ে অধিকারে কর্মি জানান, আদমজী মিলের পরিত্যক্ত গুদামের মতো বিশাল কোনো গুদামের ভেতরে ছোট ছোট খুপরি ঘরের বন্দীশালায় আরো অনেক লোক আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। ছয় ফুট বাই আট ফুট আয়তনের বন্দীখানায় একটা জানালা পর্যন্ত নেই। অনেক উচুতে লাগিয়ে রাখা এডজাস্ট ফ্যানের মাধ্যমেই শ্বাস প্রশ্বাস নেয়ার মতো বাতাসের ব্যবস্থা সচল রাখা হয়। বন্দীদের উপর চালানো নির্যাতন গুয়ানতানামো কারাগারের বর্বরতাকেও হার মানায়। দেড় সহস্রাধিক ব্যক্তি এ ধরনের রহস্যময় নিখোঁজের শিকার হলেও হাতে গোণা কয়েকজনই কেবল জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন।” (লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক)