বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:০৮ পূর্বাহ্ন

কিরণের ব্যাংক লকারে ৬০০ ভরি সোনা-হীরা

কিরণের ব্যাংক লকারে ৬০০ ভরি সোনা-হীরা

আসাদুজ্জামান তুহিন :
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ও সিটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ ৭০০ টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে হাজার টাকার মালিক হয়েছেন। তাকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। তিনি ভাগিয়ে নিয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ, দেশের সর্ববৃহৎ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়রও হয়েছেন। নির্বাচিত না হয়েও দুই মেয়াদে মোট পাঁচ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামিয়েছেন আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও হামলা করেছেন। আসাদুর রহমান কিরণের ফাঁসির দাবি জানিয়ে ২০ নভেম্বর গাজীপুর মহানগরের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ ও ঝাড়ু মিছিল করেছেন। তাদের বক্তব্য, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানকে মিথ্যা মামলায় ২৭ মাস কারাগারে রাখেন তিনি। কেড়ে নেন মেয়রের পদ।

 

অসংখ্য মিথ্যা মামলায় অধ্যাপক মান্নানকে হয়রানি করা হয়েছে। সুষ্ঠু বিচারের পর আ. লীগকে নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া হবে: ড. ইউনূসসুষ্ঠু বিচারের পর আ. লীগকে নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া হবে: ড. ইউনূস টঙ্গীর স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসাদুর রহমান কিরণের বাবা নূর মোহাম্মদ ছিলেন স্কুলের দপ্তরি। কিরণ ১৯৮৫ সালের দিকে টঙ্গীতে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামের একটি কারখানায় বাইন্ডার পদে ৭০০ টাকা বেতনের চাকরি করতেন। পরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। ওই সময় তিনি জাতীয় যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরশাদ সরকারের সময় তিনি পরিচিতি পান ভূমিদস্যু হিসেবে। এরপর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং দুই দফায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হন। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কিরণ এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। অভিযোগ রয়েছে, আসাদুর রহমান কিরণ অপরাধ ও মাদক কারবারে পৃষ্ঠপোষকতা ,চাঁদাবাজি ও কমিশনবাণিজ্য, দরপত্র ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স কম দেখানো, সিটি করপোরেশনের তহবিল আত্মসাৎ প্রভৃতিতে জড়িত ছিলেন। পার্বতীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে মিনি চিড়িয়াখানাপার্বতীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে মিনি চিড়িয়াখানা তার প্রভাবের খুঁটি ছিলেন সাবেক এমপি এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমতউল্লা খান। তাদের প্রশ্রয়েই কিরণ গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে পরিণত করেছিলেন লুটপাটের কেন্দ্রে। রাতারাতি দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। কথিত আছে, তার অবৈধ অর্থের ভাগ পেতেন আজমত ও রাসেল। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টঙ্গীর পাগাড় মৌজায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বহু জমি দখলে নিয়ে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেছেন কিরণ। টঙ্গীর বিসিক এলাকায় শ্রমিক নেতা হিসেবেও আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি।

 

সে সময় কেউ জমি দিতে না চাইলে রাজনৈতিক চাপ ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল হওয়ায় সেখানে টার্গেট করে জমি দখল করতেন কিরণ। তার ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ডিসেম্বরে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হতে পারেশেখ হাসিনাকে ফেরাতে ডিসেম্বরে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হতে পাওে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিরণের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, আসাদুর রহমান কিরণ ও তার স্ত্রীর নামে নিউ ইয়র্ক শহরে তিনটি বাড়ি রয়েছে। উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ি (সাততলা ভবন), উত্তরায় ৭ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর রোডের ৯৫ নম্বর (১২ তলা) ভবন (নির্মাণাধীন)। ভালুকা উপজেলায় নিজের ও স্ত্রীর নামে ২০০ বিঘা জমির ওপর ফ্যাক্টরি রয়েছে। রাজধানীর গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডে ২ হাজার ৫শ’ বর্গফুটের আলিশান ফ্ল্যাট এবং টঙ্গী জোনে তার তিনটি ফ্যাক্টরি রয়েছে। টঙ্গীর পাগাড়ে, আশুলিয়ায় ও গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রীর নামে, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমি রয়েছে। টঙ্গীর পাগাড়ে সংখ্যালঘুদের জমি ও মরকুন কবরস্থানের জায়গা দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রথম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়ে পাচার করা টাকায় তিনি নিউ ইয়র্ক শহরে তিনটি বাড়ি করেন। বিভিন্ন ব্যাংকের লকারে তার ৫০০-৬০০ ভরি সোনা ও হীরা রয়েছে। ২০০০ সালে টঙ্গী পৌরসভা নির্বাচনের ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনার হন আসাদুর রহমান কিরণ।

 

তখনই তিনি অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সাবেক পৌর মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমতউল্লার ‘মাইম্যান’ হয়ে ওঠেন। ক্ষমতার ভিত্তি তার পাকা হয়। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আজমতউল্লা মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। অভিযোগ রয়েছে, ষড়যন্ত্র করে মান্নানকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করিয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পেয়ে যান কিরণ। ভাগ্যের চাকা তার আরও গতি পায় প্রথম মেয়াদে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার পর। পরে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে তিনিও বরখাস্ত হন এবং কিরণ বসেন (ভারপ্রাপ্ত) মেয়রের চেয়ারে। মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতির পদও পেয়ে যান তিনি।

 

ওয়ার্ড কাউন্সিলর হয়ে তিনি প্রতাপের সঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশন শাসন করেছেন দুই মেয়াদে। ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত গাজীপুরের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান, শোক দিবস ও কর্মকর্তাদের পিকনিকসহ বিভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন না করেই সিটি করপোরেশনের খরচের তহবিল থেকে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন কিরণ। বিশ্ব ইজতেমার পরিচালনা ব্যয় দেখিয়েও কোটি কোটি টাকা লুটেছেন তিনি। সূত্র জানায়, শিল্পসমৃদ্ধ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সবচেয়ে বড় হয় শিল্প ও হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে। সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র কিরণ। প্রথম দফায় বিভিন্ন প্রকল্পের ভুয়া বিল ও দ্বিতীয় দফায় ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়েছেন কিরণ। গাজীপুর নগরীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী-ঠিকাদার মি. টেন পার্সেন্ট হিসেবে চেনে কিরণকে। টঙ্গী ও গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানার ঝুট ব্যবসায় একক নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। টঙ্গীর চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, অপরাধ সাম্র্রাজ্যেও তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |