বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩১ অপরাহ্ন
সাংবাদিকতা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশার একটি। হত্যা ও নির্যাতন,মিথ্যা মামলা,হামলা,ভয় দেখানো,লাঠিপেটাসহ নানা ঝুঁকি আছে এই পেশার।কিন্তু ভয়ে গুটিয়ে নাথেকে সাংবাদিকরা কাজ করে যাচ্ছে। তথ্য বা সত্য তুলে ধরছেনির্ভয়ে।রাষ্ট্র,সরকার,প্রভাবশালী করপোরেট,হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল,লুটেরা,সমাজ বিরোধী রাজনীতিক,ব্যবসায়ীদের মুখোশে উন্মোচন করে যাচ্ছে।গণমাধ্যমকর্মীদের ঝুঁকিটা এখানেই।অন্যান্য পেশার মতোই সাংবাদিকতা ও একটি পেশামাত্র।
গণমাধ্যম সাংবাদিক কার ও প্রতিপক্ষ নয়।বাংলাদেশে,সাধারণ মানুষ থেকে মহা পরাক্রমশালীদের বড় একটা অংশ সাংবাদিকতাকে সাংঘাতিক অপ্রয়োজনীয় এবং বিপজ্জনক বিবেচনা করে।অনেকেই উপহাস করেন-অযাচিত জ্ঞানদেন। পারলে কীভাবে রিপোর্ট লেখা বা টিভিতে দেখানো উচিত সেটাও বলে দেন।চেপে ধরলে রসিকতা বলে উড়িয়ে দেন।কিন্তু তাদের জ্ঞান দান স্রেফ রসিকতা নয়।তাদের অভিযোগ -অনুযোগের সব দাবি যে মিথ্যা তা হয়তো নয়।
মজাটা হচ্ছে,সকলেই তথ্য চায়,কিন্তু নিজের মতো করে।এর ব্যত্যয় হলেই গণমাধ্যমকর্মী সাংঘাতিক।তথ্য পক্ষে থাকলে ভালো,বিপক্ষে গেলে সাংবাদিক খারাপ,এই হচ্ছে জাতীয় মানসিকতা। অথচ কেউ বোঝেনা,গণমাধ্যম আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা একনয়।বাংলাদেশের গণমাধ্যম,প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের স্বাধীনতা চায়।অবাধ ও মুক্ত হতে চায়।কিন্তু সাংবাদিকের (কর্মীর) স্বাধীনতার বিষয়ে চুপ।নিজে শক্তিশালী হতে চায় কিন্তু তার কর্মীকে করতে চায়না।রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে ভূমিকা রাখতে চায় কিন্তু সাংবাদিকদের অংশীদার করতে চায়না।
এই সংকটই কাজের পরিবেশকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।সাংবাদিকের স্বাধীনতা হচ্ছে,ভয়মুক্ত কাজের পরিবেশ,আক্রমণ থেকে সুরক্ষা,সত্য তুলে ধরা এবং মাস শেষে বেতনের নিশ্চয় তার মতো জরুরি অনেক বিষয়।এতথ্য সবার জানা ভালো যে সাংবাদিকতা কোনও স্বাধীন পেশা নয়(নাগরিক সাংবাদিকতা বাদে)। অনেকে সাংবাদিকদের মহা ক্ষমতাধর মনে করেন।বাস্তবে কোনও ক্ষমতা নেই।কোন খবর ছাপা,কোন পাতায় ছাপা হবে না হবেনা-এটা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা বা নীতির বিষয়,সাংবাদিকের নয়।এক্ষেত্রে পুলিশ,রাজনীতিবিদ,ছাত্রসংগঠন,মাস্তানসবাই এগিয়ে।
সাংবাদিক হত্যা বা পেটানোয় কারো বিচার হয়েছে মনে করতে পারিনা।বরং গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কলম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময়ে আইন হয়েছে,হচ্ছে।রাষ্ট্র একদিকে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করছে আইনিভাবে।অন্য দিকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও তৈরি হচ্ছে।যদিও ফেসবুক বা অন্যান্য বিকল্প গণমাধ্যমের কারণে তথ্য আটকে রাখা কঠিন।কিন্তু জনগণ বিশ্বাস করে,সাংবাদিকরা অনেক তথ্য গোপন করে।
সাংবাদিকের ঝুঁকি অফিস রাস্তা উভয় ক্ষেত্রেই।সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তথ্য বা ছবি সংগ্রহ করে,জনগণের পাশে থাকে।কিন্তু বিপদে কেউ তার পাশে থাকেনা।বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিককে প্রতিষ্ঠান মালিক-সম্পাদকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় মাথায় রাখতে হয়।এরপরও চাকরির নিশ্চয়তা নেই, ঝুঁকি ভাতা নেই,পেনশন নেই,প্রভিডেন্টফান্ড নেই,শুক্র-শনি,৯ -৫ টা নেই।
এমনকি মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা নেই।সব মিলিয়ে সাংবাদিকতা প্রায় দুঃসহ একটি পেশায় পরিণত হয়েছে।এত প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে মেলে না ন্যূনতম বাহবা বা প্রশংসা।এর বদলে মেলে চাপাতি আর লাঠির বাড়ি।হাসপাতালে শুয়ে ব্যথায় কাতরায় সাংবাদিক।গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় সন্ত্রাসী।
কিন্তু যেখানে সাংবাদিকতা করাই কঠিন সেখানে বিশৃঙ্খলা হতে বাধ্য।এবং তাই ঘটছে।এজন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের দায়ও কম নয়।বহু ধারা-উপ ধারা,মতাদর্শ,দল-উপদলে বিভক্ত সাংবাদিক সমাজ একই মতাদর্শের মধ্যেও ভয়ানক কোন্দল,কাদা ছোড়াছুড়ি বিদ্যমান।দেশে সাংবাদিকদের এত সংগঠন।কিন্তু সরকার প্রশাসন,রাজনীতিবিদদের ওপর প্রভুত চাপ প্রয়োগের মতো সংগঠন নেই।নেই তেমন ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বও।ফলে পরিস্থিতি বদলায়না।
মুক্ত সাংবাদিকতা ভালো বা খারাপ দুই-ইহতে পারে।কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া সাংবাদিকতা শুধু খারাপই হতে পারে–এই ধারণা একজন আমেরিকান সাংবাদিকের।বাংলাদেশের সাংবাদিকতাও যে ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে,তা বুঝতে পণ্ডিত হওয়া লাগেনা। নানা মুখী চাপ,সেলফ সেন্সরশিপ,সংবাদকর্মীদের দলীয় আনুগত্যসহ আরও অনেক কারণেই গণমাধ্যম বিশ্বাস হারাচ্ছে।সাংবাদিকরা আক্রান্ত হওয়ার পর বিচারের দাবিতে ইউনিয়ন নেতারা বিবৃতি দেন।
মানববন্ধনের মতো কিছু কর্মসূচি থেকে সংগঠনগুলো কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়ে থাকে।কিন্তু অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যেতে লেগে থাকেনা।তাই সরকার প্রশাসন তেমন চাপও বোধ করেনা।সাগর-রুনি ঘরের মধ্যে খুন হয়ে যায়,কঠোর হতে পারলাম না। কত কত বন্ধু,সহকর্মী মাইর খেলো,আহত হলো,কঠোর হতে পারলামনা।বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম কঠোর হতে পারলামনা।নৈতিকতা বন্ধক রাখতে রাখতে,দালালি করতে করতে অধঃপতনের শেষ ধাপে নেমে গেলাম আর কবে কঠোর হবে সাংবাদিক সমাজ সেটা কেউ জানেনা।
সাংবাদিকরা যখন বিভক্ত এবং বাড়ি-গাড়ি,সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ,তদবির বা অন্য সুবিধা নিতে থাকে,তখন তার বা তাদের পক্ষে সঠিক অবস্থান নেওয়া কঠিন। সাংবাদিকদের বিভক্তি,দলবাজি,সুবিধাবাদিতার সুযোগ নিচ্ছে সবাই।ফলে আঘাত প্রাপ্ত হলেও,সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনা।অথচ সাংবাদিকতা হচ্ছে সেইশক্তি,যা প্রগতিশীল সামাজিক পরিবর্তন ও কার্যকর গণতন্ত্র বজায় রাখতে কাজ করে।ঝুঁকিপূর্ণ জেনেই সাংবাদিকরা এপেশায় আসে এবং কাজ করে।
ঝুঁকি হচ্ছে এই পেশার সৌন্দর্য।বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে,পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।সেটা পুনরুদ্ধার করাই আপাত জরুরি।পাশাপাশি,লেজুড়বৃত্তি ছেড়ে সবাইরএকতা বদ্ধ হলে,একটি দল নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম বা ইউনিয়ন দাঁড় করানো গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।তখন সাংবাদিকদের গায়ে হাত তোলার আগে দ্বিতীয় বার ভাববে সবাই।বন্ধ হবে হুটহাট ছাঁটাই।বেতন দিতে বাধ্য থাকবে মালিক সম্পাদক।
সাংবাদিক জনপ্রিয় হওয়ার জন্য সাংবাদিকতায় আসেনা।সাংবাদিকদের দায়িত্ব হচ্ছে,সত্য খুঁজে বের করা,জবাব না পাওয়া পর্যন্ত।নেতাদের ওপর অব্যাহত চাপ ধরে রাখা–যত বিচ্যুতিই থাকুক না কেন,সাংবাদিকতা মহান পেশা এবং মহানই থাকবে।
অতএব,আসুন সাংবাদিক ভাই-বোন বন্ধুরা,চুপ নাথেকে কথা বলি।একতা বদ্ধ হই।বলতেই থাকি পেশার মান সমুন্নত রাখতে এবং ওরা যতক্ষণ না থামে।