শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৯ পূর্বাহ্ন

আপডেট
অফিস নেই, প্রমাণ নেই, কাকে ধরবে পুলিশ?

অফিস নেই, প্রমাণ নেই, কাকে ধরবে পুলিশ?

টাকা নিয়ে উধাও এমটিএফই

মোঃ রহমত উল্যাহ : যদি ২৬ থেকে ৬০ ডলার বিনিয়োগ করেন, সেক্ষেত্রে তিনি প্রতিদিন ০.৩৯ ডলার থেকে ০.৬০ মার্কিন ডলার লাভ করতে পারবেন। একইভাবে ৬১ থেকে ২০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ০.৯৮ ডলার থেকে ২.০৫ ডলারের লাভ পর্যন্ত লাভ। বিনিয়োগের পরিমাণের উপর নির্ভর করে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১৬০ ডলার পর্যন্ত লাভ। বিনিয়োগকারীকে কোথাও যেতে হবে না। খুব সহজেই একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে রেজিস্ট্রেশনের পর তাদের নিজস্ব ওয়ালেটে ট্রেডের জন্য ডলার রাখতে হতো। ডলারের পরিমাণ অনুযায়ী লাভ। এ যেন ঘরে শুয়ে-বসেই আয়। বিজ্ঞাপনে এভাবেই লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং প্ল্যাটফম এমটিএফই।

এমটিএফই হচ্ছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করা এমটিএফই বাংলাদেশে এ বছরের জানুয়ারি মাসে তাদের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করে। তবে বাংলাদেশে এদের কোনো অফিস নেই। অনলাইনেই তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

বাংলাদেশে এমটিএফই-এর কত গ্রাহক আছে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি। তবে এমটিএফই-এর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মোট ৮ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে তাদের অ্যাপে। শুধু বাংলাদেশ নয় দুবাই, ওমান, কাতার সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এমটিএফইতে বিপুল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছে। বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে বলা হচ্ছে- বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে।

এমটিএফই তাদের বিজ্ঞাপনে বলতো, কেউ যদি ২৬ থেকে ৬০ ডলার বিনিয়োগ করেন প্রতিদিন ০.৩৯ ডলার থেকে ০.৬০ মার্কিন ডলার লাভ করতে পারবেন। একইভাবে ৬১ থেকে ২০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ০.৯৮ ডলার থেকে ২.০৫ ডলারের লাভ, ২০১ থেকে ৫০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫.০৯ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৫০১ থেকে ৯০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ১০.৯৩ থেকে ১৪.৬৪ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৯০১ থেকে ১৫০০ ডলার বিনিয়োগে ১৮-২৪.৪০ ডলার পর্যন্ত লাভ এবং ৩৫০১ থেকে ৫০০০ ডলার বিনিয়োগে ৮৫ থেকে ১২৫ ডলার পর্যন্ত লাভ। এমনকি ৫০০১ ডলার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত বিনিয়োগ করে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১৬০ ডলার পর্যন্ত লাভের লোভ দেখানো হয়। মুনাফা লাভের পাশাপাশি এমটিএফই ডেসটিনির মত প্রলোভন দেখায়। একজন গ্রাহক যদি নতুন কাউকে এখানে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তাহলে তিনি নতুন গ্রাহকের বিনিয়োগ থেকেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিরিক্ত আয় করতে পারবেন।

এভাবেই লোভনীয় বিজ্ঞাপনে এমটিএফই-এর ফাঁদে পা দিয়ে দেশের প্রায় ৮ লাখ মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। বাংলাদেশে কোনো অফিস না থাকায় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে বর্তমানে অনেক ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে তাদের সর্বস্ব হারানোর গল্প লিখছেন। ইতিপূর্বে ডেসটিনি-২০০০, ইউনি পে টু ইউ-এর মতো প্রতারক এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা দেখলেও এমটিএফই লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলতে ব্যর্থ হয় নি।

* প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার।
* গ্রাহকদের ওয়ালেটে ডলারের ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছে।
* গ্রাহকদের ঘাড়েও লোকসানের দায় পড়েছে।
* বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার বার্তা।
* অস্তিত্ব নেই তাও টাকা নিয়ে চলে গেল : মাহবুব কবির মিলন।

আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই এমটিএফই-এর গ্রাহকরা অভিযোগ করছিলেন যে- তাদের অ্যাকাউন্টে ডলার থাকলেও তারা উত্তোলন করতে পারছেন না। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাত থেকে দেখা যায়, অনেকের ওয়ালেটের ডলারের পরিমাণ শূন্য এবং ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছে। অর্থনীতির ভাষায় প্রতিষ্ঠান লোকসান করায় বিনিয়োগকারীরাও লোকসানের দায় নিতে হবে। ফলে গ্রাহকদের কাছ থেকে বরং এমটিএফই-ই টাকা পাবে বলে দাবি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কাস্টমার কেয়ার নেই, নেই যোগাযোগের মতো কোনো অফিস। তাই বিনিয়োগকারীরা সবাই এ বিষয়ে ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করেন। চট্টগ্রামের পলিন আহমেদ নামে এক বিনিয়োগকারী জানান, ‘আমি বাংলাদেশি টাকার প্রায় ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ৬৫ হাজার টাকা আয় করেছিলাম। এরপর আমি ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে সব হারিয়েছি।’ মোস্তফা রহমান নামে আরেকজন বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমি ৯৩০ ডলার বিনিয়োগ করে দৈনিক ১৫০০ টাকার মতো আয় করতাম। আমার ওয়ালেটে মোট ৫ হাজার ডলারের মতো জমা ছিল। তবে আমি কোনো টাকাই তুলতে পারিনি। আজ সেটা মাইনাস ১ হাজার ২০০ ডলার দেখাচ্ছে।’

এইদিকে শুক্রবার এবং শনিবার অ্যাপে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এমটিএফই গ্রাহকদের জানায়, ‘এমটিএফই একটি ব্রোকার প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা ডলার দিয়ে ট্রেডিং করতে সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করেছে, তাই সবার ব্যালেন্স ঋণাত্মক বা মাইনাসে চলে গেছে। বিনিয়োগকারীদের এর দায়ভার নিতে হবে। তাই প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে নিজ নিজ লোকসানের অংক দেওয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি এ পরিমাণ ডলার পরিশোধ করা না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শুরুর দিকে অনেকেই ব্যবসাটি গোপনে করলেও অন্যদের অতি লাভের আশায় ডেসটিনির মতো অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রকাশ্যে সভা-সেমিনার করতে দেখা যায় অনেককে। বেশি পরিমাণ ডলার বিনিয়োগ করলে এমটিএফই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের ‘সিইও’র টাইটেল দেওয়া হয়। তবে তারা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত কেউ নন, শুধুমাত্র টাইটেলই পেয়েছেন।

জানা যায়, একজন এমটিএফই-এর ‘সিইও’ হতে হলে বিনিয়োগকারীকে প্রতি সপ্তাহে দুইজন নতুন বিনিয়োগকারী আনতে হবে। সেই নতুন বিনিয়োগকারীর কমপক্ষে বিনিয়োগ থাকতে হবে কমপক্ষে ৫০১ মার্কিন ডলার। ‘সিইও’রা যাদের যাদের বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাদের কাস্টমার সার্ভিসসহ সব ধরনের সাপোর্ট দিতেন।

এই বিষয়ে সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, এমটিএফই-এর বিষয়ে আমাদের নজরদারি চলছে। বাংলাদেশে এদের যারা রিপ্রেজেন্টটিভ বা মার্কেটিং-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। এছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেন, সে অভিযোগও গ্রহণ করে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এমটিএফই একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম চক্র। তাদের কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ বায়বীয়।

বাংলাদেশে এমটিএফই-এর অবৈধ কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ মেজবাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিএফআইইউ কিছুদিন আগে একটা সভা করেছে। বিএফআইইউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে কিছু সাইট বন্ধ করেছে। এখনো কিছু চলছে। তারা আবার নতুন রূপে আসছে। আমরা সতর্কতামূলক সার্কুলার দিয়েছি, কি কি বৈধ আর কি কি অবৈধ। জনগণকেও সতর্ক হতে হবে। বৈধতা দেখেই লেনদেন করা উচিৎ। অতিমাত্রায় লোভী হয়ে গেলে কিন্তু বিচার বিবেচনা থাকে না। এ ক্ষেত্রে আমরা বারবারই বলছি বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে।

এইদিকে এমটিএফই-এর কার্যক্রম ও মোটা অংকের টাকা পাচারের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে এক পোস্ট এ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন লিখেন, ‘যার কোনো অফিস নেই, অস্তিত্ব নেই, স্বচ্ছতা বা অ্যাকাউন্টিবিলিটি নেই, সরকারের কোনো স্বীকৃতি নেই, কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই, শুধু একটা অ্যাপের ভিত্তি করে এত আর্থিক সংকটের পরেও এ দেশের প্রায় ৪২ লাখ মানুষ ১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা লোপাট করার সুযোগ করে দিলো!’

‘রাতারাতি ‘সিইও’, রাতারাতি কাঁচা টাকা পাওয়ার লোভকে কত সহজে কাজে লাগিয়েছে এমটিএফই নামের এক প্রতিষ্ঠান! ১ বিলিয়ন ডলার! আর আমরা কিছুই টের পেলাম না! আর একদিন অন্য কেউ, অন্যরূপ নিয়ে আসবে। আবার জাল পাতবে। আবার হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাবে। এরপর মাথা চাপড়াবেন হতভাগারা। আমরা কেউ টের পাব না। পরে শুরু হবে তদন্ত। কত সহজ এ মাটি থেকে টাকা লোপাট করা! সোনার খনি এ মাটি।’

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |