বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৪৩ অপরাহ্ন
আনিসুর রহমান রুবেল: জাতীয় পচিয়পত্র গোপন করে আবদুল কাদির নামে এক ব্যক্তিকে ৫৪ বছর বয়সে দেখিয়ে ময়মনসিংহ ডিসি অফিসে চাকরি দেওয়া হয় । একই প্রক্রিয়ায় ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে তিনটি পদে মোট ১৭ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটে ময়মনসিংহ ডিসি অফিসের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও ভারতের এজেন্ট ড. সুভাস চন্দ্র বিশ্বাসের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের নিয়োগ কমিটিতে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্মচারী নিয়োগ বিধি লঙ্ঘন ও আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নিয়োগ কমিটির ছয় সদস্য ও নিয়োগ পাওয়া ১৭ জনসহ মোট ২৩ জন মামলার পরিবর্তে দায়মুক্তি পেয়েছেন। অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুদকের সহকারি পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ কমিটির প্রধান, ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড.সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনসহ (বর্তমান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব) নিয়োগ কমিটির ছয়জন ও নিয়োগ পাওয়া ১৭ জনসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর সুপারিশ করে।
পরে কমিশন ২০২১ সালে ১৬ নভেম্বর সংস্থাটির তৎকালীন সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে এই নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি নিষ্পত্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্তির করেন। তবে দুদকের ওই চিঠিতে কেন নিষ্পত্তি করা হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে দুদকের সাবেক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, আমি এই সংক্রান্ত কিছু জানি না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন কিছু ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। অনিয়মের বিষয়টি অনুসন্ধান করে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ময়মনসিংহ। ওই কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম ফজলুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়োগে অনিয়ম সংক্রান্ত ফাইলটি নিষ্পত্তির কারণ জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বিষয়টি মনে করতে পারেননি। পরে বলেন, হ্যাঁ নিয়োগ সংক্রান্ত একটি বিষয় নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে কেন নিষ্পত্তি হয়েছে আমি সঠিক জানি না। গুরুতর এই অনিয়মের বিষয়টি অনুসন্ধান করেন দুদকের ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন সহকারী পরিচালক সাধন চন্দ্র সূত্রধর।
তবে এই অনিয়মের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র প্রতিদিনের কাগজ কে জানায়, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিভিন্ন পদে ১৭ জনের নিয়োগপত্র ইস্যু করে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। অফিস সহায়ক পদে ১৩ জন, নিরাপত্তা প্রহরী ৩ জন ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে নিয়োগ পান তারা। নিয়োগ কমিটির প্রধান তৎকালীন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ড. সুভাস চন্দ্র বিশ্বাস জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স গোপন করে জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে বয়স কমিয়ে চাকরিতে যোগদান করতে সহায়তা করেন। আর বিনিময়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন। তবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বয়স সঠিক বলে দাবি করেন ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন,আমি জয়েন্ট করার আগে সেখানে একটা বাছাই কমিটি ছিল। তারা বাছাই করে একটি তালিকা করেছে। নিয়োগে জন্মনিবন্ধন জমা দেওয়ার অপশন ছিলো। ফলে চাকরি প্রার্থীরা জন্ম নিবন্ধন দাখিল করে। পরে বাছাই কমিটি সেটি সুপারিশ করে। তবে এই ধরণের নিয়োগে আমাদের লেভেলের কেউ দেখে না। তাদের (চাকরি প্রর্থীদের) জন্মনিবন্ধনের কাগজ সঠিক ছিলো বলেই বাছাইয়ে তারা টিকে যান। আমি কোন ঘুষ নেয়নি। নিয়োগের সময় তাদের কারো বয়স ৫৪ ছিলো, কারো ৫৩, নিয়োগ বোর্ড সেটা ধরতে পারেনি, জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও জন্মনিবন্ধন দিয়ে চাকরি দেওয়ার বিষয়টা বিধি বহির্ভূত কী না জানতে চাইলে সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘বয়স কত সেটা আপনি কীভাবে বুঝবেন? কাগজপত্র দেখে যখন সঠিক মনে হয়েছে সেই অনুযায়ী কাজটা হয়েছে। আর অফিস প্রধান হিসেবে কাগজগুলোই আমার কাছে এসেছে।’
তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। সরকারি কর্মচারি নিয়োগ বিধির সঙ্গে সাবেক এই জেলা প্রশাসকের কোনো কথার মিল পাওয়া যায়নি। কারণ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ১৩ নং শর্তে বলা হয়েছে- চূড়ান্ত বাছাই করা প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট পেলেই নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন। কিন্তু চাকরি প্রার্থীরা যোগদান করেন ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর আর পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাগজ জমা হয়েছে ২০১৯ সালে ১৯ মার্চ। অর্থাৎ নিয়োগের তিন মাস পর তাদের পুলিশ ভেরিফিকেশন দেওয়া হয়। আর স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টও পাওয়া যায় চূড়ান্ত নিয়োগের দুই দিন পর। অন্যদিকে ২০১৬ সালে পত্রিকায় দেওয়া এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে তিন পদে আবেদন করেন ৬ হাজার ৯৭৮ জন। তাদের মধ্য থেকে মাত্র ৩০১টি আবেদন প্রথমিক বাছাই শেষে বাতিল করেন করেন তৎকালীন ডিসি। তার বদলির পর পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ঘুষ বানিজ্য করেছেন সামলেছেন ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। দুদকের অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণের পর অভিযুক্তদের কোনো ধরণের ব্যাখা ছাড়া কমিশন দায়মুক্তিকে অপরাধ হিসেবে দেখছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, ‘দুদকের নিজস্ব অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণের পর নিয়োগ কমিটিসহ নিয়োগ পাওয়া ২৩ জন কীভাবে দায়মুক্তি পেলো তার একটা ব্যাখ্যা থাকা জরুরি।
দুদক একটি অনুসন্ধান ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান। এমন একটি প্রতিষ্ঠান অনৈতিক কাজ করতে পারে না। যদি করে থাকে অবশ্যই দুদকের একটি ব্যাখ্যা দিতে হবে।’ এই ধরণের কাজ দুদকের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে বলে মনে করেন তিনি। দুদকের একজজন কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, চাকরি প্রার্থীর বয়স ২৮, ২২, ২০ বছর কীভাবে কমাতে পারে? পয়ত্রিশ বছরের একজনকে ত্রিশ বলা যায় বা ২৮ বলা যায়, কিন্তু ৫৪ বা ৫৩ বছরের বেশ কয়েকজনকে ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় কেউ বুঝলো না এরা বয়স চুরি করছে অথবা কেউ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র চেক করা উচিত বলেও মনে করলো না। একজন নয়, এমন ১৭ জনের বেলায় যখন এটা ঘটে তখন এটা অবশ্যই উদ্যেশ্য প্রণোদিত। তবে দুদক এই অভিযোগ থেকে তাদেরকে কেন দায়মুক্তি দিলো সেই বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। নিয়োগ বোর্ডের যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ- ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীর জেলা প্রশাসক বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, সেখানকার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও বর্তমান জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপ সচিব শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, তৎকালীন ডিসি অফিসের নেজারাত ডেপুটি কালেক্টর বর্তমানে মাদারীপুর শিবচরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এম রকিবুল হাসান, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর বর্তমানে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদা হাসান।
তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের অবসর প্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান। বয়স কমিয়ে নিয়োগ পাওয়া ১৭ জন হলেন- অফিস সহায়ক পদে চাকরি পেয়েছেন ১৩ জন। নিয়োগ পাওয়া অফিস সহায়ক মো. আব্দুল কাদিরেরর জাতীয় পরিচয় পত্রের তার জন্মসাল ১৯৬৫। জন্ম চাকরি পেতে ম্যানেজ করা জন্ম নিবন্ধনে তিনি জন্ম তারিখ উল্লেখ করেন ১৯৯৩। প্রকৃত বয়সের চেয়ে কমিয়েছেন ২৮ বছর। তিনি যখন সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন তখন তার প্রকৃত বয়স ছিলো ৫৩ বছর। একই পদে ২২ বছর কমিয়েছের আবুল কাসেম। তার প্রকৃত জন্মসাল ১৯৬৪। তিনি জন্ম নিবন্ধনে দিয়েছেন ১৯৮৬ সাল। ২০১৮ সালে তার চাকরিতে যোগদানের সময় বয়স ছিলো ৫৪ বছর। ২০ বছর কমিয়েছেন মো. আকরাম হোসেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্মসাল ১৯৬৯, কিন্তু তিনি জন্ম নিবন্ধনে ২০ বছর কমিয়ে জন্মসাল দেন ১৯৮৯। চাকরিতে যোগদানের সময় তার বয়স ছিলো ৪৯ বছর। এছাড়া অফিস সহায়ক পদে নিজেদের প্রকৃত বয়স থেকে ১১ কমিয়েছেন মো. শামসুল আলম ও মো. ওমর ফারুক। ১০ বছর করে কমিয়েছেন মো. একাব্বর হোসেন, আট বছর কমিয়েছেন মো. শহিদুল ইসলাম, সাত বছর কমিয়েছেন মো. ওবায়দুর রহমান, আসল বয়স থেকে পাঁচ বছর কমিয়েছেন মো বাবুল হোসেন ও মো. আব্দুস সাত্তার, চার বছর কমিয়েছেন মাহমুদ আল ফয়সাল তামিম, তিন বছর কমিয়েছেন জোবায়ের আলম ও এক বছর শিহাব হোসেন মানিক।
অন্যদিকে নিরাপত্তা প্রহরী পদে জাতীয় পরিচয়পত্রের বয়স গোপন করে জন্মনিবন্ধন দিয়ে বয়স কমিয়েছেন তিনজন। তাদের মধ্যে নয় বছর কমিয়েছেন মো. আব্দুল মান্নান, চার বছর মো. রুহুল আমীন ও তিন বছর মো. আব্দুল কাদের জিলানী। পরিচ্ছন্নতাকর্র্মী পদে নিয়োগ পাওয়া লক্ষী রানী দাস নিজের বয়স কমিয়েছন ছয় বছর। দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে ২৮ অক্টোবর একাটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তিন পদে জনবল নিয়োগের আহ্বান করা করে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। তখন জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন মো. খলিলুর রহমান। ২০১৬ সালে পত্রিকায় দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০১৮ সালে ১২ মার্চ জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস। পরে অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী এই তিনপদে ১৭ জনকে ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর নিয়োগপত্র ইস্যু করেন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়।