সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন
খায়রুল আলম রফিক : ময়মনসিংহে নগরীতে শুধু ফুটপাত থেকেই ফাঁড়ি ও থানা পুলিশের নামে চাঁদা আদায় হয় মাসে ৫৪ লাখ টাকা। নানা শ্রেণি পেশার মানুষের চলাচল গাঙ্গীনার পাড়, ট্রাংপট্রী, দুর্গাবাড়ী,নতুনবাজার ও চিকিৎসা নগরী চরপাড়া। নিত্যপ্রয়োজনীয়, প্রশাধনী ও চিকিৎসার প্রয়োজনে ৬ জেলার মানুষসহ নানা প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশি মানুষের পদচারণা থাকে সেখানে। দিন রাতে সবসময়ই থাকে ভিড় । আর এসব এলাকায় ফুটপাতের দোকান বসানোর কারনে সাধারন মানুষের চলাই দায়। প্রায় তিন বছর ফুটপাত মুক্ত থাকলেও সম্প্রতি এক বছর ধরে আবারও দোকান বসানো হয়েছে গণহারে । গাঙ্গীনার পাড়, ট্রাংপট্রী, দুর্গাবাড়ী, চরপাড়া হাসপাতাল গেইট, নতুনবাজার মেইন রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে বসানো হয়েছে প্রায় ৫ শতাধিক দোকান। অভিযোগ আছে, পুলিশের কয়েকজন অসৎ কর্মকর্তা পুলিশ সুপারের নামে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে চাঁদা তুলেন। গড়ে প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ৩২০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। মাসে ৫৪ লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয় ফুটপাত থেকে । এক পুলিশের অসৎ কর্মকর্তা টাকা তোলার সময় প্রকাশ্যে দোকানিদের বলেন, এক বড় স্যার বাদে অন্যারা নেন ট্রেনের টিকেট ও বিভিন্ন বাজার । আমাদের কি করার আছে? আমরা খেলনার পুতুল!
ফুটপাত থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ টাকার মত চাঁদা আদায় হয় অথচ একাধিকবার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাসুম আহম্মেদ সাংবাদিকদের সাথে বৈঠকে বলেছেন ফুটপাত ও যানজট মুক্ত শহর হবে ময়মনসিংহ। দেড় বছরও এই কথার বাস্তবায়ন করতে পারেনি পুলিশ সুপার ।সাধারণ মানুষের মাঝে চলছে নানা আলোচনা। এক ফুটপাতের দোকানদার বলেন, কিছু সাংবাদিক সাহেবের ফেসবুক আইডিতে যখন দেখি যানজট নিরসনে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে পুলিশ তখনই আমার হাসি পায় । মনে হয় কিছু অসৎ পুলিশের সাথে এবং সাংবাদিকরাও বিক্রি হয়ে গেছে। তাদের ফেসবুক দেখলে মনে হয় শহরে কোন যানজট নেই। চাঁদাও তোলা হয় না। তিনি আরও বলেন,আসল সাংবাদিকের সংখ্যা কম, তেলবাজ এর সংখ্যা বেশি ময়মনসিংহে। নগরীর গাঙ্গীনার পাড়ে এত পথচারী অথচ সেখানে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলাচল করার কোনো সুব্যবস্থা নেই। দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে না গাঙ্গীনার পাড়, চরপাড়া, ট্রাংপট্রী, দুর্গাবাড়ী সড়কের ফুটপাতগুলো।
পুরো ফুটপাতজুড়েই বসানো হয়েছে দোকান। পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে নানা রকমের বাজার সাজিয়ে রেখেছে অবৈধ দখলদার। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার মতো পরিস্থিতি নেই সেখানে। তাই বাধ্য হয়ে পথচারীরা নেমে এসেছেন মূল সড়কে। যে কারণে যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সেই সঙ্গে তো থাকছে পথচারীদের দুর্ঘটনার আশঙ্কাও। দেখার কেউ নেই।গাঙ্গিনাপাড় এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী বীরেন্দ্র পাল বলেন, এসপি আবির সাহেব থাকতে প্রায় সময়ই ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদের অভিযান করত। তখন শহরের মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে চলাচল করতে পারতো।চরপাড়া হাসপাতাল এলাকার ঔষধ ব্যবসায়ী রানা চৌধুরী বলেন, চরপাড়া ফুটপাতের কারণে আমাদের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতেও সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। নিজের একটা গাড়ি আছে, বের করতে পারিনা যানজটের কারণে। তাই বাধ্য হয়ে রিকশায় চলাচল করি ।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাঃ মোস্তফা কামাল রিকসায় যাচ্ছে তার চেম্বারে । কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। ডাক্তার সাহেব বলেন, আমি তিন বছর এখানে। ঘরে একমাস নিজের গাড়ি ব্যবহার করেছি। না হয় রিক্সায় চলি। আমার কাছে মনে হয়েছে এটি রিক্সার শহর। যানজট সম্পর্কে তিনি বলেন,কিছু অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার কারণে আজ শহর যানজট। তারা দীর্ঘদিন ধরে এ কি কর্মস্থলে। কিভাবে টাকা অর্জন করতে হয় এটা তারা ভাল করেই জানেন। ভাই ফুটপাত সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো।
কথা হয় ময়মনসিংহ জজ কোর্টের আইনজীবী হাসানুজ্জামানের সাথে তিনি বলেন,আমার বাসা কপিক্ষেত। প্রতিদিন হেঁটে কোর্টে যাই। রিক্সায় গেলে লাগে এক ঘন্টা আবার ভাড়াও বেশি। তাই বিকল্প পথ বেছে নিলাম। গতকাল পুলিশ লাইন্স এলাকায় কথা হয় একজন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে। তিনি রিকসায় তার মেয়েকে নিয়ে নতুন বাজার কোচিং এ যাচ্ছিলেন। প্রতিবেদক তার কাছে জানতে চান, আপনার তো গাড়ি আছে, তাহলে রিক্সায় কেন? উত্তরে তিনি বলেন, রিকশায় আসলেও সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। অনেক সময় হেঁটে চলে আসি। শহরে যে এত যানজট কেন, মাথায় কাজ করে না। তিনি রিকোয়েস্ট করেন আমার নাম লিখবেন না।গাঙ্গীনার পাড় ও চরপাড়া হাসপাতাল গেইট রাস্তার সামনের মূল সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ভালুকা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা বিলকিস । সামনে স্বামী মনিরুল ব্যাগ কাঁদে নিয়ে হাটছেন, পেছনেই অটোরিকশাচালক হর্ন বাজিয়ে বলছিলেন’ আপা একটু সাইড দিয়ে হেঁটে যান’। চালকের কথা শুনে বিলকিস বলছেন ‘কোথায় যাব ভাই ? ফুটপাতে দোকান, রাস্তায় গাড়ি, বিপাকে আমাদের মতো পথচারী’।
প্রতিবেদকের কথা হয় বিলকিস এর সঙ্গে। তিনি বলেন, পুরো হাসপাতাল এলাকা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। সবগুলো ফুটপাতে অতিরিক্ত দোকান, তার মধ্যে মানুষের হেঁটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এত ভিড় থাকে যেখানে পুরুষ মানুষই হাঁটতে পারে না আর আমরা মেয়ে মানুষ? কিভাবে হাঁটব?পথচারীদের চলাচলের জন্য থাকা ফুটপাতে কেন? আপনাদের দোকান এমন প্রশ্নের জবাবে ফুটপাতের দোকানি জজ মিয়া বলেন, টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। মানুষও হাঁটুক আমাদেরও ব্যবসা হোক।ফুটপাতে দোকান না বসালে কই যামু, বাজারে দোকানঘর নেয়ার মতো তো পুঁজি নাই। তাই প্রতিদিন লাইনম্যানকে টাকা দিয়ে দোকান চালাই। টাকা আদায়ের ব্যাপারে এক ফুটপাত ব্যবসায়ী বলেন, ফাঁড়ি পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদা তুলেন। সাথে থাকে লাইনম্যানও। গাঙ্গীনারপাড়, ট্রাংপট্রী, দুর্গাবাড়ী ও চরপাড়া ১ নং ও ৩ নং ফাঁড়ির পুলিশ আসে। সাথে থাকে লাইনম্যানও।
সামনে ফুটপাতে পথচারীদের চলাচলের কোনো পরিস্থিতি নেই, পুরো এলাকা হকারদের দখলে।এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলর বলেন, পথচারীদের চলাচলের জন্য ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে আমরা খুবই তৎপর থাকি ।যে কারণে মাঝে মধ্যেই এ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করি। যেহেতু এগুলো স্থায়ী দোকান না সে কারণে আমাদের অভিযানের সময় তারা সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে পালায়, আবার এসে বসে। যতটুকু শুনেছি, কিছু লাইনম্যান চাঁদা তোলে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উৎপাত তুললে কি হবে? আটক বা গ্রেফতার করার ক্ষমতা তো আমাদের নেই? আছে পুলিশের, তারা কি করে? আমার সামনে নির্বাচন, এসব কিছু বললে আমার ভোট কমে যাবে। নাগরিক আন্দোলনের নেতাদের মতে, হাঁটার নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ না থাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের মধ্যে পথচারীদের সংখ্যাই বেশি। অপর্যাপ্ত ও হাঁটার অনুপযোগী ফুটপাত এবং রাস্তা পারাপারের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পথচারীদের আগ্রহ থাকার পরও তারা হাঁটতে পারছেন না। পথচারীদের হাঁটার পরিবেশ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাদের মূল রাস্তা ব্যবহার করতে হচ্ছে।