রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৪ পূর্বাহ্ন

এনএসআই কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে অঢেল সম্পদ, লেনদেন শতকোটি টাকা

এনএসআই কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে অঢেল সম্পদ, লেনদেন শতকোটি টাকা

এনএসআই কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে অঢেল সম্পদ, লেনদেন শতকোটি টাকা

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদফতরের (এনএসআই) একজন কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে অঢেল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঐ নারীর ব্যাংক হিসাবে ১৫ বছরে শত কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে, যা তাদের আয়ের উৎস সাপেক্ষে অস্বাভাবিক। অনুসন্ধান চালিয়ে এই দম্পতির জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়ে দুজনের নামে মামলা করেছে দুদক। অভিযুক্ত ঐ কর্মকর্তা হলেন এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক আকরাম হোসেন ও তার স্ত্রী সুরাইয়া পারভীন।

জানা গেছে, আকরামের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ১৫ বছরে জমা হয় ১২৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। একই সময়ে তুলে নেয়া হয় ১২৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আরো জানা গেছে, স্ত্রীর নামে ব্যবসা দেখানো হলেও ব্যাংকিং লেনদেন করেছেন স্বামী। দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় এ দম্পতির একাধিক ফ্ল্যাট, দোকান ও জমি আছে। ঢাকার বাইরে নাটোরে আছে বাড়ি ও জমি। কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও জমি কেনা হয়েছে। সাভারের বিরুলিয়ায় আছে সাড়ে ছয়তলা বাণিজ্যিক ভবন।

বর্তমানে এনএসআইয়ের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আকরাম হোসেনের নামে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। এছাড়া তিনি দুদকে জমা দেওয়া সম্পদের বিবরণীতে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। আর সুরাইয়ার প্রায় ২১ লাখ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক মশিউর রহমান মঙ্গলবার গণমাধ্যমে বলেন, আকরাম হোসেন ও সুরাইয়া পারভীনের নামে ২১ মে মামলা করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, আকরাম হোসেন এনএসআইয়ের পরিচালকদের সহকারী হিসেবে কাজ করার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন তৈরির ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয় দুদক। আকরাম নাটোরের নওপাড়ার বাসিন্দা। তিনি ১৯৮৯ সালে নিম্নমান সহকারী হিসেবে এনএসআইয়ে যোগ দেন। আট বছর পর বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে মাঠ কর্মকর্তা (জুনিয়ার ফিল্ড অফিসার) হন। ২০১৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হন।

দুদক ২০২০ সালে আকরাম ও তার স্ত্রীর সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আকরাম ২০০২ সালে প্রথম নাটোরে ২৪ শতাংশ জমি কেনেন। এরপর বিভিন্ন সময় স্ত্রী ও নিজের নামে ঢাকার দক্ষিণখানে আড়াই শতাংশ, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ২০ শতাংশসহ মোট প্রায় ২০৮ শতাংশ জমি কিনেছেন। সবচেয়ে বেশি জমি কিনেছেন ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে।

জানা গেছে, আকরাম অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে তার স্ত্রী সুরাইয়ার নামে ২০০৮ সালে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। কিন্তু সেই ব্যবসার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই বলে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। মোট ২৫টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সুরাইয়ার ব্যবসার যে আকার, তাতে এত টাকা লেনদেন করা অস্বাভাবিক। দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, ঢাকায় সুরাইয়া পারভীনের মোট ২৫টি ব্যাংক হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১২৬ কোটি ৩৩ লাখ ১৫ হাজার ১৪৪ টাকা জমা হয়। একই সময় এই হিসাবগুলো থেকে তুলে নেয়া হয়েছে ১২৫ কোটি ২৫ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৪ টাকা; যা অস্বাভাবিক।

এজাহারে আরো বলা হয়, ‘স্টার ইলেক্ট্রা ওয়ার্ল্ড’ ও ‘লিরা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেড’ নামে দুই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সুরাইয়ার নামে দেখানো হলেও ব্যবসাসহ ব্যাংকিং লেনদেন করেন তার স্বামী আকরাম হোসেন। সাভারের বিরুলিয়ার পুকুরপাড় এলাকায় ২০১৫ সালে আকরাম ১৬ দশমিক ৪০ শতাংশ জায়গা কেনেন। সেখানে সাড়ে ছয়তলা ভবন বানানো হয়েছে। ভবনটির নাম ‘স্টার কমপ্লেক্স’। একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত তার স্ত্রীর নামে থাকা ‘মেসার্স স্টার ইলেক্ট্রা ওয়ার্ল্ডের’ কারখানা গড়ে তোলেন। এই কারখানায় বৈদ্যুতিক পাখা, বাতিসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী তৈরি করা হয়।

ঐ ভবন তৈরি করতে ৪ কোটি ৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা খরচ করেছেন বলে দুদকে তথ্য দেন আকরাম। তবে দুদক অনুসন্ধানে জেনেছে, ভবনটি নির্মাণে খরচ করা হয়েছে ৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকার বেশি। এ ক্ষেত্রে আকরাম প্রায় ১ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার টাকা খরচের তথ্য গোপন করেছেন। ঐ ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আফজাল প্রামাণিক জানান, ভবনের মালিক আকরাম নামের এক ব্যক্তি। ভবনটির পাঁচতলা পর্যন্ত এখন খালি রয়েছে। শুধু ছয়তলায় পোশাক তৈরির একটি কারখানাকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

ভবনটির বিষয়ে নাম না প্রকাশ করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, মূলত বিদেশ থেকে সরঞ্জাম এনে স্টার ইলেক্ট্রা ওয়ার্ল্ডে ইলেকট্রনিক সামগ্রী তৈরি করা হতো। শুরুর দিকে কারখানায় অনেক মানুষ কাজ করতেন। স্থানীয় এক দোকানি বলেন, ভবনের মালিক একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি প্রতি শুক্রবার একটি গাড়ি নিয়ে এখানে আসেন। কয়েক ঘণ্টা থেকে আবার ফিরে যান। মিরপুরের সেনপাড়া এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন আকরাম। ‘মেগা হারবর’ নামের ভবনের তৃতীয় তলায় ২২ লাখ টাকা দিয়ে ২০১৫ সালে আকরাম ও তার স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাটটি কেনা হয়।

ভবনটির ব্যবস্থাপক আলতাফ আলী জানান, দুই সন্তান নিয়ে আকরাম এই বাসায় থাকেন। তার স্ত্রী ব্যবসা করেন কি না, জানতে চাইলে আলতাফ বলেন, ম্যাডাম তো বাসায় থাকেন। তাকে খুব বেশি বাইরে যেতে দেখি না। ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নুরুল ইসলাম বলেন, স্যারের (আকরাম) একটি গাড়ি আছে। পরিবার নিয়ে কোথাও গেলে গাড়িটি ব্যবহার করেন। তবে অফিসে যাওয়া-আসার জন্য একটি মোটরসাইকেল আছে স্যারের।

দুদক অনুসন্ধানে জেনেছে, মিরপুরে একই এলাকায় আকরামের নামে ১০০ বর্গফুটের একটি দোকান রয়েছে। আর সুরাইয়ার নামে একই এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট ও ১ হাজার ৬৫০ বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক জায়গা রয়েছে। তবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয় অস্বীকার করেন আকরাম হোসেন। তিনি জানান, তার নিজের ও স্ত্রীর নামে থাকা সব সম্পদ বৈধ। স্ত্রীর ব্যবসার আয় থেকে তিনি এসব সম্পদ করেছেন। এর সবকিছুই আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ রয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে হয়রানি করে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নতুন নয়। এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন, সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, এনএসআইয়ের কর্মকর্তারা তো মানুষের ওপর নজরদারি করেন। তাদের কর্মকর্তারা কোনো অপরাধে জড়াচ্ছেন কি না, সেটিও নজরদারি করা উচিত।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |