মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: সংখ্যাটা বিশাল। প্রায় সাত লাখ। যার পুরোটাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া। তাদের সঙ্গে ওই সময়ে পদোন্নতি পাওয়া আরও সাড়ে তিন লাখের বেশি যোগ হবে। সবমিলিয়ে সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিধাভোগী’ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫০ হাজার ৬৮৩ জনে, যা প্রশাসনে হিমালয়ের মতো বিশাল এক খাম্বা। শূন্য পদ বাদে বর্তমানে কর্মরত মোট ১২ লাখ ৩১ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তাদের খুঁজে বের করতে গেলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার জোগাড় হবে বলে মনে করছেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিধাভোগী’ এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয় ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৯ জনকে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিয়োগের হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে আগের ১৪ বছরের গড় হিসাব ধরলে ওই অর্থবছরে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৬ হাজার ৩৫৭ জনকে। অন্যদিকে ২০০৯-১০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে পদোন্নতি পান ৩ লাখ ৩১ হাজার ৬৩৯ জন। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পদোন্নতির হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে আগের ১৪ বছরের গড় হিসাব ধরলে ওই অর্থবছরে পদোন্নতি পান আরও ২৩ হাজার ৬৮৮ জন।মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়াদের তথ্য তালাশ হচ্ছে। নাস্তা নিয়ে নাস্তানাবুদ করার অভিযোগে প্রশিক্ষণের প্রায় শেষপ্রান্ত ছুঁয়েও পুলিশে ‘আপাতত’ নিয়োগবঞ্চিত হচ্ছেন কয়েকশ প্রশিক্ষণার্থী এসআই। অর্ধডজন বিসিএস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসবের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বক্তব্যে প্রশাসন গুলজারময় হয়ে উঠেছে। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় বিবেচনায় চাকরি পাওয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে গত ১৫ বছরে প্রায় সবই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছু লোক ঢুকে পড়েছে যারা কোনোমতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তারা নানা কায়দা-কানুন করে চাকরিতে ঢুকেছে। কিছু লোক টাকার বিনিময়ে ঢুকেছে। প্রশাসনের জানামতে ভিন্নমতের লোকদের চাকরিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের বাইরে যেন কেউ ঢুকতে না পারে সেজন্য দফায় দফায় তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিস ও কিছু নন-ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়ার আগে দুটি সংস্থাকে দিয়ে প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এরপরও সন্দেহ হলে জেলা প্রশাসন পুনরায় তদন্ত করেছে। সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের বলতে হয়েছে তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক। আর লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় যত ভালো করুক না কেন জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের জন্য চাকরিতে ঢোকা ছিল লোককাহিনি বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘরে প্রবেশের মতোই কঠিন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘গত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া সব লোক আওয়ামী লীগের না। তবে তৎকালীন সরকার সব রকম চেষ্টা করেছিল নিজেদের লোক নিয়োগ দিতে। তারপরও কিছু ঢুকে গেছে। যাই হোক, প্রশাসনে সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। আওয়ামী লীগ করে বলে তাদের দেখে নেওয়ার সুযোগ নেই। এসব বক্তব্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবীরা বিধি-বিধান অনুযায়ী চাকরি করেন উল্লেখ করে এই জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তাদের ইচ্ছা করলেই বাদ দেওয়া যায় না। এখন বাদ দিলেও সরকার বদলে গেলে তাদের কাজ না করিয়েও পদোন্নতিসহ বকেয়া টাকা একসঙ্গে ফেরত দিতে হয়। যে দল ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল তাদের দলীয় লোক নিয়োগ হবেই। সব সরকারই সেটা করে। এবার টানা ১৫ বছর থাকায় আওয়ামী লীগ প্রচুর জনবল নিয়োগ দিয়েছে। তাদের মধ্যে কে কীভাবে নিয়োগ পেয়েছে তা বাছাই করতে গেলে চোখে শর্ষেফুল দেখতে হবে। কাজেই এসব বাদ দিয়ে প্রশাসনে গতি ফেরাতে হবে।
প্রশাসনে এমনিতেই আস্থাহীনতা। তারপর খুঁজে বের করার তৎপরতা। এই যুগপৎ অবস্থানে প্রশাসনে গতি বলতে কিছু নেই। রুটিন কাজেও চরম অনীহা। অন্দরমহলে বিচরণকারীদের কাছে এ প্রশাসন একেবারেই অচেনা। সর্বত্রই কৌতূহল, কী হচ্ছে? বিশেষ করে গত সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের কীভাবে আলাদা করা হচ্ছে? যেখানে প্রায় সবই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ হয়েছে। সেখানে তাদের আলাদা করার মানদ- কী হতে পারে এসব নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এসব আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেই উঠে আসছে গত ১৫ বছরের নিয়োগকাণ্ড। নিয়োগে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলেও তা থামানো হয়নি। এর ফলে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। একেক ক্ষেত্রে একেক স্টাইল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বিশ^বিদ্যালয়গুলোয় অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত দেড় যুগে ছাত্রলীগ না করলে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়নি। উপাচার্যরা শেষ কর্মদিবসে বিশ^বিদ্যালয় ছাড়ার সময় নিয়োগ দিতে বাধ্য হতেন। সাধারণ বিশ^বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র একই অনিয়ম হয়েছে।
চাকরি দেওয়ার ইউনির্ভাসিটি স্টাইল : রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের কোনো বিভাগ জনবল চায়নি, প্ল্যানিং কমিটি কোনো শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেনি, বিশ^বিদ্যালয়ের কোনো অফিস জরুরি ভিত্তিতে জনবল চেয়ে চাহিদাপত্রও পাঠায়নি। তারপরও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান ২০২১ সালের ২৬ মে বিদায় নেওয়ার আগে নিজের শেষ কর্মদিবসে তড়িঘড়ি করে ১৩৭ জনকে নিয়োগ দিয়ে গেছেন। নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বড় অংশের পরিচয় হলো, তারা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক কিংবা প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। বিশ^বিদ্যালয় ছাড়ার দিন উপাচার্য বলেছিলেন, ‘মানবিক’ বিবেচনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া তার শেষ কর্মদিবসে ‘তাড়াহুড়ো’ করে বিপুলসংখ্যক নিয়োগ দিয়েছিলেন। অবশ্য পরের উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ সেসব নিয়োগ বাতিল করে দেন। আর যিনি বাতিল করেছেন তিনিও অবৈধভাবে সহস্রাধিক নিয়োগ দিয়েছিলেন। শুধু রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় বা বিএসএমএমইউ নয়, সব পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে একই স্টাইলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
অমানবিক আউটসোর্সিং : আমলারা নীতিনির্ধারকদের যেভাবে বুঝিয়েছেন সেভাবেই চলেছে। ভালোমন্দ খতিয়ে দেখা হয়নি। আউটসোর্সিং নীতিমালা করার সময়ই বলা হয়েছে এ নীতিমালা টিকবে না। কর্মচারীকে অভুক্ত রেখে সরকারের সাশ্রয় করার নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাছাড়া সরকার যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের যন্ত্রণা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে চায় সেখানে কে নতুন করে মধ্যস্বত্বভোগীদের সুযোগ করে দিয়েছে সে প্রশ্নও উঠবে। আমলারা সেই সময়ের সরকারপ্রধানকে বুঝিয়েছিলেন, সরকারের খরচ কমাতে হবে এবং সেবার মান বাড়াতে হবে। এ কারণে আউটসোর্সিং পদ্ধতি উপযোগী। কিন্তু এ পদ্ধতিতে একজন কর্মচারী ঈদের সময় বোনাস পাবেন না, বছর শেষে তার বেতন বাড়বে না, তিন বছর পর চাকরি থাকবে না এসব অসুবিধার কথা আড়াল করা হয়েছে। এই অমানবিক আউটসোর্সিংয়ের চাকরি নিতে গিয়েও চাকরিপ্রার্থীদের মাথাপিছু ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। কারণ তারাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আউটসোর্সিংয়ের আওতায় জনবল সরবরাহ করতেন। সেই আউটসোর্সিং কর্মচারীরা এখন রাজপথে মিছিল করছেন। তাদের ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার দুর্দশার কাহিনি বলে বেড়াচ্ছেন।
অভুক্ত আনসার সদস্যরা রাজপথে কেন : আনসার সদস্যরা রাজপথে নেমে আসেন। কিন্তু রাজপথে নামার আগে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে ধরনা দিয়েছেন। যদিও সমস্যা সমাধানে কোনো মন্ত্রী-সচিব এগিয়ে আসেননি। একজন ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্য তিন বছর চাকরির পর বাড়ি ফিরে যাবেন। এরপর তিন মাস চাকরি থাকবে না। তখন তার সংসার চলবে কী করে? বিষয়টি আনসার সদস্যরা পইপই করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের। কিন্তু তারা গা করেননি। তারা মনোযোগী ছিলেন নতুন নিয়োগ দিতে। কারণ নতুন নিয়োগেই লাভ, পকেট ভারী হয়।
ন্যাশনাল সার্ভিসে অনিয়ম : ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ২০১০ সালে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। এ কর্মসূচির আওতায় বেকার যুবক ও নারীদের তিন মাস প্রশিক্ষণের পর সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের জন্য অস্থায়ী চাকরি দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণকালে প্রতিদিন ১০০ টাকা ভাতা আর চাকরিতে যোগদানের পর প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৩ বছরে এই কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। বিপুল এই টাকায় বেকার যুবক-নারীদের কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও নানা কায়দায় এর উল্লেখযোগ্য অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরই বাছাই ও চাকরি দেওয়া হয়। ন্যাশনাল সার্ভিসে সাধারণ বেকারদের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি।ডিও নাই তো প্রাথমিকে চাকরিও নাই : এক যুগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হয় বলে জানান সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে গত ৩ মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে তিনি এ তথ্য জানান। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডিও লেটার (এমপিদের দেওয়া আধাসরকারি পত্র) ছাড়া প্রায় কারোরই চাকরি হয়নি। নিদেনপক্ষে স্থানীয় এমপিকে বলতে হয়েছে প্রার্থীকে তিনি চেনেন বা জানেন। জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘শুধু নিয়োগ আর পদোন্নতির কারণেই নয়। সরকারি চাকরিজীবীরা বেতন বৃদ্ধির কারণেই সরকারের ওপর সন্তুষ্ট ছিল।