বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:১৮ অপরাহ্ন

হত্যা মামলার আসামিদের বাঁচাতে ডিভোর্সি স্ত্রীকে বাদী বানালেন ওসি মনজুর কাদের

হত্যা মামলার আসামিদের বাঁচাতে ডিভোর্সি স্ত্রীকে বাদী বানালেন ওসি মনজুর কাদের

বিশেষ প্রতিনিধি :
লবণ শ্রমিক দানু মিয়াকে অপহরণ করে পেকুয়ায় নিয়ে হত্যা এখন কক্সবাজার জেলাজুড়ে আলোচনায়। তার পরিবার যখন শোকাহত, তখন তাদের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের ভূমিকা। তারা অভিযোগ করে বলেন, পরিবারের সদস্যদের মামলা না নিয়ে খুনিদের বাঁচাতে দানু মিয়ার ডিভোর্সি স্ত্রী রুজিনা বেগমকে বাদী সাজিয়ে মামলা করেছেন ওসি। অথচ পাঁচ বছর আগে দানু মিয়াকে তালাক দেওয়া রুজিনা বর্তমানে অন্যত্র সংসার করছেন। তবে, চকরিয়া থানার ওসি মনজুর কাদের ভূঁইয়ার দাবি, নিরীহদের আসামি হওয়া থেকে বাঁচাতে উপরের নির্দেশে নিহতের স্ত্রীকে বাদী করে মামলা করা হয়েছে। দানু মিয়া মহেশখালীর বড় মহেশখালী ইউনিয়নের মাহারাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। পেকুয়ার কলেজছাত্র জিহাদ হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থায়ী জামিনের জন্য ১০ ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। পথে তার গাড়ি আটকে দুর্বৃত্তরা দানু মিয়া ও তার সঙ্গী মুবিনকে অপহরণ করে। তাদের পেকুয়া সদরের একটি অজ্ঞাতস্থানে রাখা হয়। দিনভর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে পেকুয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে তাদের ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। পুলিশ খবর পেয়ে দানু মিয়া ও মুবিনকে উদ্ধার করে পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় সেখান থেকে দানু মিয়াকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল। পথে পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকায় গাড়িতেই তার মৃত্যু হয়।

পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দানু মিয়ার বোন জোসনা আক্তার মামলার বাদী হবেন। জোসনা নিজেই চকরিয়া থানায় ১৪ জনকে আসামি করে এজাহার জমা দেন। তার দাবি, থানার ওসি মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া তাকে চারজন আসামির নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেন। এই চারজন হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। ওসির নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানালে কৌশলে তাকে বাদ দিয়ে রুজিনা বেগমকে বাদী করা হয়। জোসনা আক্তার অভিযোগ করেন, ‘রুজিনা আমার ভাইকে পাঁচ বছর আগে ডিভোর্স করেছেন। এখন তিনি কেনাখালী চরপাড়ার বাসিন্দা আবদুস সালামের ছেলে মাহমুদুল করিমের সঙ্গে সংসার করছেন। এই অবস্থায় তিনি কীভাবে মামলা করতে পারেন? এটা আসামিদের বাঁচানোর ষড়যন্ত্র। রুজিনা আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে মামলাটি বিক্রি করেছেন। জোসনা আরও বলেন, ‘আমি যে এজাহার জমা দিয়েছি, তাতে প্রধান অভিযুক্তরা ছিল। অথচ রুজিনা বেগমের করা মামলার এজাহার থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত খুনিদের বাঁচাতে ওসি এই কাজ করেছে। আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার পাব কিনা, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে,চকরিয়া থানার ওসি মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া বলেন, জোসনা আক্তার অনেক নিরীহ ব্যক্তিকে আসামি করার চেষ্টা করেছেন। এসব নিরীহ ব্যক্তিদের নাম বাদ দিতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি শুনেননি। তাই ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে তার এজাহার গ্রহণ করা হয়নি। পরে দানু মিয়ার স্ত্রী রুজিনা বেগম বাদী হয়ে ১১ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। দানু মিয়াকে ডিভোর্স দেওয়া রুজিনা কি করে বাদী হন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার ডিভোর্স হয়নি। আর মামলার বাদী আমি নই, ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে নির্ধারণ করা হয়েছে। এঘটনর সতত্যা জানতে চকরিয়া থানার ওসি মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়ার মোবাইলে কথা বলেন, দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার মনসুর আলম মুন্না। মুন্না কেন জানতে চাইলেন তাকে মামলা ছাড়াই কক্সবাজার থেকে গতকাল রাত ১২.৩০ মিনিটে তুলে ২০ ঘন্টা অন্ধকারে ফেলে রাখে। তারপর চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠায় ওসি মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া।

ওসি মনজুর কাদের যত অভিযোগ

২০০৩ সালে বিএনপির আমলে নিয়োগ হলেও স্বৈরাচারী সরকারের আমলে বিএনপি -জামায়াত দমনে ‘দানবের ভূমিকায় ছিলেন এই আলোচিত মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া । কক্সবাজারের ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে উপপরিদর্শক (এসআই) থাকাকালীন আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘিরে এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি অধ্যুষিত ফেনী এলাকার বাসিন্দা হলেও এই মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া গোপালী পুলিশের চেয়ে ভয়ংকর ছিল। চকরিয়া থানায় তার পদায়নের খবর ছড়িয়ে পড়লে ভুক্তভোগীদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার সৃষ্টি হয় এবং তাকে প্রত্যাহারের দাবি তুলেন অনেকেই। স্থানীয়দের তথ্য মতে, বর্তমান ঈদগাঁও উপজেলাটি কক্সবাজার সদরের অংশে ছিল। ওই সময়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় তত্বাবধানে চললো ঈদগাঁও তদন্ত কেন্দ্রটি। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে দীর্ঘ দিন ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি অফিসার হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া। ওই সময় তিনি অনেকটা বিএনপি-জামায়াত দমনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। এমনকি স্বৈরাচারী সরকারের মহলকে খুশি করতে গায়েবী মামলা দেয়া তার নেশায় পরিনত হয়।বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতা ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঈদগাঁতে গায়েবী মামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত এই মনজুর কাদের ভূইয়া। ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত ঈদগাঁও তদন্ত কেন্দ্রের আইসি থাকাকালীন নানা অপকর্মের জন্ম দেন।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৩ সালের শুরুর দিকে আল্লামা সাঈদীর মামলার রায় পরবর্তী বিক্ষোভ দমনে ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সামনে রশিদ নামের এক ব্যক্তিকে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে প্রথমে গুলি করে ও পরে তদন্ত কেন্দ্রের ভিতরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন মনজুর কাদের ও তার অপর সহযোগী সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রূপন চৌধুরী। এ ঘটনায় বিএনপি- জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন তিনি। (মামলা নং জিআর ১৬৫/ ২০১৩)। এছাড়া ঈদগাঁওকে ঘটনাস্থল দেখিয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ডজনখানেক গায়েবী মামলা দায়ের করেন তিনি। তখন ঈদগাঁও বাজারের ব্যবসায়ীস বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকজনকে গনহারে আটক করে তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে আসতেন। পরে দাবীকৃত পরিমান টাকা না দিলে অকথ্য নির্যাতনের পর গায়েবী মামলায় আটক দেখিয়ে চালান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ওই সময়ে এই ওসি মনজুর কাদের ভূইয়া বিরুদ্ধে ঈদগাঁওর হাজারো সাধারণ জনতাকে আসামী করে গায়েবি মামলা দায়ের করার নজির রয়েছে। এর মধ্যে জি আর ৯৩৬ /২০১২, ৯২১ /১২, ১৫০/২০১৩, ১৫১ /১৩, ৮৮৯/১৩, ১৬৫/১৩ ও জি আর ১১/২০১৪সহ অনেক গায়েবী মামলার নায়ক তিনি। তার পদায়নের খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় কযেকজন ভুক্তভোগী ঈদগাঁওতে কর্মকালীন সময়ে তার অত্যাচারের বিষয়ে বণর্না দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাকে প্রত্যাহারের দাবি তুলেন। অনেকেই তার বিরুদ্ধে পূর্বের ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান। অপরদিকে এই আলোচিত মনজুর কাদের ভূইয়া বিরুদ্ধে ঈদগাঁও থাকাকালীন মামলা বাণিজ্য, মানব পাচারকারীদের সাথে সখ্যাতা সহ নানা অভিযোগের পাহাড় রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ’র দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, পদায়নের আগে নিজ এলাকা থেকে তার কর্মকাণ্ড ভেরিফিকেশন করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে কোন বিরূপ মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া তিনি এই জেলায় ওসি হিসেবে পূর্বে কর্মরত ছিল না। এই বিষয়টি গুরুত্ব বিবেচনা করে তাকে পদায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, পদায়নের পর সকল নতুন ওসিদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থে এই নির্দেশ মেনে না চললে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রটি ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি তদন্ত কেন্দ্র থেকে থানায় রুপান্তরিত হয়।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2025 Protidiner Kagoj |