বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫০ অপরাহ্ন

শিল্প গ্রুপের দখলে গাজীপুরের বনভূমি

শিল্প গ্রুপের দখলে গাজীপুরের বনভূমি

রেজাউল করিম রেজা: শিল্প গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলেছে। প্রশাসনের কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে বনের জমি দখল করে কারখানা, খামার, হ্যাচারি, আলিশান রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পট নির্মাণ করেছে পৌনে ২ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগত প্রভাব এবং কিছু অসাধু বন কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্যক্তিগত জমির সঙ্গে থাকা বনের জমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। সংরক্ষিত বনে বা বন ঘেঁষে তৈরি করা এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকটির নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। বনের গাছপালা উজাড় করে কোনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে রাস্তা। আবার সংরক্ষিত বনের ভিতর বিভিন্ন গার্মেন্ট শ্রমিকদের সুবিধার কথা বলে খাবার হোটেল, ছোট ছোট চায়ের দোকান গড়ে উঠেছে।

এসবও বনের ক্ষতি করছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শ্রীপুরে ধনুয়া মৌজায় আরএকে সিরামিকস ৪ একর, রশোওয়া স্পিনিং মিল ৪ একর, ডিবিএল সিরামিকস ৮ একর, অটো স্পিনিং মিলস ২.২০ একর, সাতখামাইর মৌজায় আকন্দ গার্ডেন ১৬ একর, রিফাত ব্যাগ ২৫ শতক, পটকা মৌজায় ট্রেড ম্যানেজমেন্ট করপোরেশন ৭.৬৪ একর, কেওয়া মৌজার মিতা টেক্সটাইল ২.২০ একর, মেঘনা কম্পোজিট ৪০ শতাংশ, ওমেগা সুয়েটার ১ একর, সোলার সিরামিকস ৯০ শতাংশ, ইকো কটন ৪.৮৬ একর, ভাওয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ ২ একর, অনটেক লিমিটেড ৪.৯৪ একর, হাউ আর ইউ টেক্সটাইল ১ একর, অরণ্যকুটির ২.২২ একর, উইষ্টেরিয়া টেক্সটাইল ৫.৩৩ একর, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল ২ একর, এপেক্স নিট কম্পোজিট ১১.৬২ একর, গ্রেটওয়াল সিরামিকস ৭.৩৮ একর, টেপিরবাড়ী মৌজায় ডিবিএল গ্রুপ ৬ একর, তেলিহাটি মৌজায় কুঞ্জু বিথি ১ একর, আলিফ অটো ব্রিকস ৭০ শতাংশ, টেপিরবাড়ী মৌজায় চায়না বাংলা প্যাকেজিং ১ একর, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যালস ৭৬ শতাংশ, এইচ এস অ্যাগ্রো দেড় একর, রেক্স অটো ব্রিকস ১ একর ৭০ শতাংশ, টেংরা মৌজায় শিশুপল্লী প্লাস সাড়ে ১২ একর, মম পোলট্রি ৭০ শতাংশ ও ওয়ারবিট স্টিল বিল্ডিং ২ একর বনের জমি দখল করেছে।

পেলাইদ মৌজায় সিসিডিভি ৫ একর, সাইটালিয়া জামান পোলট্রি ২ একর, মাওনা মৌজার মনো ফিড ২.২৫ একর, এইচ পাওয়ার লিমিটেড ৩৩ শতাংশ, হোম ডিজাইন ১.২২ একর ছাড়াও বিবিএস কেবল, দি সোয়েটার, ইকো কটন মিলস, সিটিসেল লিমিটেডও বনের জমি দখল করেছে। জানা গেছে, গাজীপুর সদর উপজেলায় বনভূমি দখলে সবচেয়ে এগিয়ে পারটেক্স গ্রুপ। পারটেক্স কটন লিমিটেড সদর উপজেলার ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান রেঞ্জের বাহাদুরপুর মৌজায় সিএস ২৫৪, ২৮৯, ২৯৪ ও ৩০০ নম্বর দাগে ১১.৬৭ একর, পারটেক্স হোল্ডিংস লিমিটেড একই মৌজার সিএস ২০৮, ৫৮৫, ২০৮ ও ৫৮৬ নম্বর দাগে ৫.০৯ একর, আম্বার ডেনিম লিমিটেড আড়াইশ প্রসাদ মৌজায় আরএস ৮ থেকে ১৮ এবং ২৮ থেকে ৩২ নম্বর দাগে ২৬.২৪ একর বনভূমি দখলে রেখেছে। তবে এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি পারটেক্স গ্রুপের কোনো কর্মকর্তা। বোকরান মণিপুর মৌজায় সিএস ৫৯৮ নম্বর দাগে ফু-ওয়াং সিরামিক ও ফু-ওয়াং ফুডের দখলে রয়েছে ৪.৪০ একর সংরক্ষিত বনভূমি।

 

এটি উচ্ছেদে ২০০৭ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উচ্ছেদ মামলা করে বন বিভাগ। কিন্তু ওই সময় দায়সারা মামলা করায় আজও জমি উদ্ধার হয়নি। গাজীপুর সদরের নলজানী এলাকার ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। ৯/১০ বছর আগে নির্মাণের সময় ভাওয়াল রিসোর্টের পাশে থাকা সংরক্ষিত বনের বাড়ইপাড়া মৌজার এসএ সিএস ৩, ২৭৯ ও ২৭১ দাগের ৩.৬৮ একর জমি দখল করে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে, এ ঘটনায় বন বিভাগ গ্রিনটেক রিসোর্টের দখল থেকে জমি উদ্ধারের জন্য গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে উচ্ছেদ মামলা করে। কিন্তু সে জমি এখনো উদ্ধার হয়নি। বন বিভাগের তালিকা অনুযায়ী, গাজীপুরের শ্রীপুর, কালিয়াকৈর ও সদর উপজেলায় ১২ হাজার ৩২১ একর বনের জমি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে অবৈধ দখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৭৪টি প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে ৯০০ একর জমি। অবশিষ্ট ভূমি রিসোর্ট, বাড়িঘর-দোকানপাট, হাটবাজার ও কৃষিজমি হিসেবে দখল করা হয়েছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িঘর তৈরি করে ২৩ হাজার ব্যক্তি দখল করেছে ১০ হাজার একরের বেশি বনভূমি। এতে বনভূমি উজাড় হয়ে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

 

অথচ এ আগ্রাসন ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বন বিভাগের। কালিয়াকৈরের সোহাগ পল্লী রিসোর্ট, চন্দ্রা বিটের কালামপুরের রাঙ্গামাটি ওয়াটার ফ্রন্ট ও চন্দ্রার শিল্পী কুঞ্জ, কোকোলা ফুড প্রডাক্টস, কৌচাকুড়ি মৌজায় সিএস ৯৪২ নম্বর দাগে ১৫.০৫ একর বনভূমিতে ঘরবাড়ি বানিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে। এসব বনভূমি উদ্ধার করতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে উচ্ছেদ মামলার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গাজীপুরের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা বনাঞ্চল রক্ষায় আইনি ব্যবস্থা সব সময় চালু রেখেছি। যখনই কোনো অভিযোগ পাই যে বনের কোনো জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেটা উচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বন বিভাগের কাছ থেকে যে কটি উচ্ছেদের বিষয় আমাদের কাছে আসে, আমরা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে সেসব উচ্ছেদ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। এ ছাড়া বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে রাস্তাঘাট বা অন্য কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করছি।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2025 Protidiner Kagoj |