বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৫৭ অপরাহ্ন
আজ ল্যাভয়সিয়ে-কে নিয়ে লেখার দুটো কারণ আছে: প্রথমত, গেল সপ্তাহে আমি প্যারিস গিয়েছিলাম, এই শহরেই এই মহান রসায়নবিদের জন্ম এবং মৃত্যু। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে: এই সপ্তাহেই তাঁর জন্মদিন (২৬শে অগাস্ট, ১৭৪৩, নবাব সিরাজুদৌলার জন্মের দশ বছর আগে)।
ধনীর দুলাল হয়েও তিনি বিলাসব্যাসনে জীবন পার না করে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন বিজ্ঞান-র জগতে। অবশ্য সেই সময়ে ধনীর দুলাল না হলে বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব হতো না, কেননা এখনকার মতো সরকার গবেষণার ল্যাবরেটরি নির্মাণ করে দিতো না। নিজের আগ্রহে এবং নিজের উদ্যোগেই গবেষণাগার তৈরি করে নিতে হতো। তবে তখনকার ফরাসি রাজকীয় বিজ্ঞান অ্যকাডেমির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মাসোহারা পেতেন— রাজার জন্য কাজ করবেন সেই শর্তে। মাত্র ২৩ বছর তিনি ফরাসি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির স্বর্ণপদক লাভ করে হৈচৈ ফেলে দেন— বড়ো শহরকে আলোকিত করার ব্যাপারে এক প্রবন্ধ লিখে। ১৭৭২ সালে তিনি প্রথম দেখান যে হীরক-কে আগুনে পুড়ানো সম্ভব, এর পরে ধারাবাহিকভাবে ল্যাভয়সিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলি সামনে আনতে থাকেন।
সালফার বা ফসফরাস-কে বাতাসে পোড়ালে যে জৌগ তৈরি হয় তার ভর মূল সালফার বা ফসফরাসের চেয়ে বেশি। অর্থ্যাৎ বাতাসের কিছু একটা সালফার বা ফরফরাসের সাথে রাসায়নিকভাবে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছে যাতে তাদের ভর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ যে কোনো কিছু পুড়ে গেলে তার ভর বা ওজন কমে যাবে তাই-ই সাধারণভাবে আমরা চিন্তা করি। তিনি এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে তার একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। বিজ্ঞানের মূল মন্ত্র ঠিক সেখানেই। সুচারুভাবে পরীক্ষা পদ্ধতি তৈরি, পরীক্ষা থেকে পাওয়া ফলাফল বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া। তিনি বুঝতে পারলেন বাতাসে এমন কিছু উপাদান আছে যা সালফার, ফসফরাস বা এই জাতীয় মৌলের ভর কে বাড়িয়ে দিতে পারে। এখন খুব সাধারণ মনে হলেও আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে এই চিন্তা সাধারণ কিছু ছিল না। ঠিক সমসাময়িক সময়ে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী প্রিস্টলি অক্সিজেন আবিষ্কার করেছেন, এবং কিছুদিনের মাথায় ইউরোপ ভ্রমণের অংশ হিসাবে তিনি প্যারিসে হাজির হলেন ১৭৭৪ সালে। তিনি ল্যাভয়সিয়ের সাথে দেখা করে তাঁকে জানালেন অক্সিজেন আবিষ্কারের খবর। ল্যাভয়সিয়ে আরও কিছু ধাতুর সাথে বাতাসের বিক্রিয়া করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, আসলে বাতাসের অক্সিজেন ধাতু বা অধাতু (সালফার, ফসফরাস) এর সাথে রাসায়নিক ভাবে সংযুক্ত হয়ে তাদের ভর বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া আমরা প্রাণীকুল এই অক্সিজেন গ্রহণ করেই বেঁচে থাকি!
আজ স্কুলের বাচ্চাও জানে এই প্রক্রিয়াকে জারণ হবে। কিন্তু আড়াইশো বছর আগে এই সিদ্ধান্তে আসা চাট্টিখানি কথা না।
ল্যাভয়সিয়ে শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেন না, সাথে আয়কর বিভাগের বড় কর্তাও ছিলেন। ষোলোতম লুই-এর রাজত্বে তখন শোষণের জয়ডঙ্কা। ধনীরা বিন্দুমাত্র ট্যাক্স না দিলেও দরিদ্র চাষী বা সামান্য দোকানীকে উঁচু দরের ট্যাক্স দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। বছরের পর বছর এই নিপীড়ন আর কত সহ্য করা যায়। তাই তারা ফুঁসে উঠলো- এলো বিপ্লব, যাকে আমরা জানি ফরাসি বিপ্লব হিসাবে। তারা আক্রমণ করলো প্যারিসের বাস্তিল দুর্গ, রাজার দপ্তর, সবশেষে ভার্সাই-এর রাজপ্রাসাদ। রাজার মন্ত্রী, বড়ো কর্তা থেকে শুরু করে রাজা বা রানি কেউই সেই আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেন না. শেষে রাজার ট্যাক্স বিভাগে চাকুরির অপরাধে বিপ্লবীরা ল্যাভয়সিয়ে-কেও ধরে নিয়ে এলো। তার পরে বিচারের নামের প্রহসনে ১৭৯৪ সালের ৮ই মে তাঁকে এবং তার শশুরকে গিলোটিনের ধারালো ব্লেডের নীচে গলা কেঁটে হত্যা করা হয় প্যারিসের উম্মত্ত জনতার সামনে।
এই হত্যায় তৎকালীন একজন আফসোস করে বলেছিলেন “’এমন একজনকে এক মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করা সম্ভব হলেও, এইরকম একজনের জন্মের জন্য আমাদেরকে হয়তো এক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে”
লেখার সূত্র: জন গ্ৰীবিন-র সুলিখিত বই ‘সায়েন্স: এ হিস্ট্রি’।