বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৭ অপরাহ্ন

কক্সবাজার বনভূমি দখলের পর স্টাম্পে বেচাকেনা

কক্সবাজার বনভূমি দখলের পর স্টাম্পে বেচাকেনা

মনসুর আলম মুন্না :
দখলের পর স্টাম্পে বেচাকেনা, এরপর গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। প্রকাশ্যে এভাবে বাপ-দাদার সম্পত্তির মতো কয়েক বছরে অন্তত ৫০০ একর বনভূমি দখল ও বিক্রি হয়েছে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জ এলাকায়। গত এক বছরে দখল হয়েছে আনুমানিক ১০০ একর। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। একটি প্রভাবশালী চক্র বনভূমিতে এমন রাজত্ব চালালেও রহস্যজনক কারণে বন বিভাগ জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। ক্ষেত্র বিশেষে দখল, বিক্রি, স্থাপনা নির্মাণ ও পাহাড় কাটায় নেপথ্যে সহায়তা দেয় বন বিভাগ। এমনকি বনভূমি বিক্রির ২৫ ভাগ টাকা বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর কক্সবাজার ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের জয়নাল আবেদীনের মেয়ে নাছরিন জাহান রোনা স্থানীয় বদিউল আলমের ছেলে মোঃ জাহাঙ্গীর আলম এবং মৃত শফিউল আলমের ছেলে আবুল কালামকে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় ৫৬ কড়া নন জুডিসিয়াল স্টাম্পে (স্টাম্প নং খগ ২৬৪২৭১৮) ফুলছড়ি মৌজায় বনভূমি বিক্রি করেছেন। রোনা ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আব্দু শুক্কুরের স্ত্রী। প্রতিবেদকের হাতে আসা কাগজে আরও দেখা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন ২০ শতক বনের জমি ২ লাখ টাকায় বন্ধক রাখেন ইসলামপুরের উত্তর নাফিতখালীর মৃত আব্দুল মতলবের ছেলে ছাবের আহমদ। ২০২১ সালের ১ অক্টোবর ফুলছড়ি মৌজার ৮.৬৭ শতক জমি বিক্রি করেন (স্টাম্প নং খঘ৮৫৪৪২০৭-৮-৯) নতুন অফিস জুমনগর এলাকার সোনা আলীর ছেলে মোঃ সেলিম। ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ জুমনগর এলাকার ছৈয়দ করিমের ছেলে শামসুল আলম ফুলছড়ি মৌজার ৬ কড়া বিক্রি করেছেন (স্টাম্প নং কন২২৬০০৪৫)। আবু তাহেরের ছেলে দেলোয়ার হোসাইন প্রকাশ মনু ফুলছড়ি মৌজার ১০ কড়া জমি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন (স্টাম্প কঠ ৭৬৯২৬৮৯)। এভাবে বনভূমি প্রকাশ্যে স্টাম্পে বেচাকেনা চলছে।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, ঈদগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও স্থানীয় চেয়ারম্যান আবুল কালাম, তার দুই ভাই বিএনপি থেকে সদ্য আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া মোঃ শরিফ (ধর্ষণ ও অস্ত্র মামলায় কারাগারে আছেন) ও নব নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য আরিফুল ইসলাম, ৬ নং ওয়ার্ড সদস্য শাহাব উদ্দিন, ভিলেজার পাড়ার মৃত বদর আমিন হেডম্যানের ছেলে ওবাইদুর রহমান এবং ফকিরা বাজারের বাসিন্দা ফিরোজ প্রকাশ দালাল ফিরোজ (তিনিও ধর্ষণ মামলায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন) সিন্ডিকেট বনভূমি দখলের সাথে জড়িত। নেপথ্যে থেকে নিজেদের অনুসারিদের দিয়ে নন জুডিসিয়াল স্টাম্প মূলে বনের জমির দখল বিক্রি করেন তারা। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঈদগাঁও ফুলছড়ি রেঞ্জের আওতাধীন নাপিতখালী বন বীট এলাকায় ফকিরা বাজারের উত্তর প্রান্তে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে বনবিভাগের সংরক্ষিত জমিতে ওবাইদুর রহমান নির্মাণ করেছেন বাণিজ্যিক মার্কেট।

এর পেছনে রয়েছে তার ভাড়া বাসা। এর একটু উত্তর পার্শ্বে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করে বসতি করেছেন। সেখানে পাহাড় ও শতবর্ষী গর্জন গাছ (মাদার ট্রি) কেটে এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। ভিলেজার পাড়ায় বনের জমি দখল ও পাহাড় কেটে বালু বিক্রির নেতৃত্বও দিচ্ছেন এই ওবায়দুর। এ সিন্ডিকেট সদস্যদের অন্যতম মোঃ শরীফ, ফিরোজ, ওবায়দুর ও আরিফ। সিন্ডিকেটটি ফুলছড়ি রেঞ্জের নাপিতখালী বিটের পূর্ব নাপিতখালী সুলতান নগর, দুদুমিয়ার ঘোনা, ফুটখালী, ভিলেজার পাড়া, ঈদগাঁও থানার সামনে সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে, থানার সামনে, ফকিরা বাজারের পূর্ব পার্শ্বে ভোমরিয়া ঘোনা বীট এলাকার বাম বাগান এলাকা ও তার আশেপাশে কয়েকশত বসতি গড়ে তুলেছে। যা পাহাড় কেটে দখল বিক্রি করেছেন এ সিন্ডিকেট সদস্যরা। এছাড়া ফকিরা বাজারের উত্তর প্রান্তে মাদার ট্রি গর্জন গাছের বাগানটি দখল করেছেন চেয়ারম্যান আবুল কালাম। বর্তমানে খন্ড খন্ড দখল বিক্রি করছেন তিনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আবুল কালাম অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন। ইউপি সদস্য আব্দু শুক্কুর বলেন, বনভূমি দখলদার একটি গোষ্ঠী আমাকে ভিলেজারের দায়িত্ব থেকে সরানোর জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমার স্ত্রী জমি বিক্রির বিষয়টি সত্য নয়। জমি দখল ও বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করলেও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে ফুলছড়ি রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা ফারুখ বাবুল বলেন, ফুলছড়ি রেঞ্জের ৫টি বিটের আওতাধীন প্রায় ৬ হাজার দখলদার রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা দায়ের করা হয়েছে। যারা যারা জমি বিক্রি করছে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, আমরা যখন কোন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি তখন জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাঁধার সম্মুখীন হয়।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2025 Protidiner Kagoj |