বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৫ অপরাহ্ন

টানবাজারের‘বাদশা’এখন বস্ত্র খাতের ‘বাদশা’ মিয়া

টানবাজারের‘বাদশা’এখন বস্ত্র খাতের ‘বাদশা’ মিয়া

সেলিম সরকার,ঢাকা : ১৯৭৫ সালের সেই কিশোর আজকের মো. বাদশা মিয়া। নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে ৪৬ বছরে বস্ত্র খাতের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের একজন হয়েছেন। তিনি হলেন স্ত্র খাতের ‘বাদশা’ মিয়া। প্রতিষ্ঠা করেছেন বাদশা টেক্সটাইল, কামাল ইয়ার্ন, পাইওনিয়ার নিটওয়্যার ও পাইওনিয়ার ডেনিম নামের চারটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ময়মনসিংহের ভালুকা ও হবিগঞ্জে বাদশা মিয়ার চার কারখানায় কাজ করেন ৩১ হাজারের শ্রমিক। বছরে লেনদেন ৪০ কোটি ডলারের বেশি, যা দেশীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার পুরোটাই সরাসরি বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানি অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা। টানা পাঁচবার রপ্তানি ট্রফি পেয়েছে বাদশা টেক্সটাইল ও কামাল ইয়ার্ন।
নারায়ণগঞ্জের কাঠপট্টি এলাকায় নেমে হেঁটে হেঁটে এলেন টানবাজারে। এলাকার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের গদিতে উঠলেন। রাশি রাশি সুতার মধ্যেই দিলেন ঘুম। কয়েক দিন পর রব ভূঁইয়া নামের গদি থেকে এক বান্ডিল সুতা (১০ পাউন্ড) বাকিতে কিনে এক ক্রেতার কাছে বিক্রি করলেন। তাতে মুনাফা হলো ৪ টাকা। বাদশা মিয়ার ইচ্ছা, তিলে তিলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান কয়েক শ’ বছর টিকে থাকুক। আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হোক। সে জন্য ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে করপোরেট সংস্কৃতির চর্চা গড়ে তুলছেন। তবে নেতৃত্বে সব সময় নিজেরা থাকতে চান। বললেন, বেশি বেশি আরাম-আয়েশ করলে প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ে। প্রতিষ্ঠানকে টেকসই করতে হলে কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করতে হয়। এর বিকল্প কোনো বুদ্ধি নেই।

বাদশা মিয়া বলেন, ‘শুরুর দিকে আমার টাকাপয়সা ছিল না। গাজীপুরের কাশেম কটন মিলের নির্বাহী পরিচালক মঈনুল ইসলাম সাহেব আমাকে স্নেহ করতেন ও খুবই ভাল বাসতেন। ১-২ বেল সুতা আমার নামে বরাদ্দ দিতেন। সেই সুতা জয়দেবপুর পর্যন্ত গরুর গাড়িতে করে এনে বাসে ওঠাতাম। তারপর ফুলবাড়িয়া স্টেশন পর্যন্ত এসে বাস বদল করে নারায়ণগঞ্জে নিতাম। এভাবে বেশ কিছুদিন ব্যবসা করেছি। ১৯৭৬ সালে পাইকারি সুতা বিক্রির লাইসেন্স করেন বাদশা মিয়া। টানবাজারে ভাড়ায় গদি নেন এবং কয়েক মাসের ব্যবধানে ভালো একটি জায়গায় সেটিকে স্থানান্তর করেন। তখন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) আশরাফ, জিনাত, মন্নু, অলিম্পিয়া, কাদেরিয়াসহ কয়েকটি বস্ত্রকল থেকে সরাসরি সুতা কিনে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি শুরু করেন। বিভিন্ন হাটেও সুতা বিক্রি করেছেন। বললেন, ‘বেশি মুনাফার আশায় টেক্সটাইল মিল থেকে সুতা নিয়ে সরাসরি হাটে হাটে দৌড়াতাম। আবার অনেক সময় রাতের বাসে বিভিন্ন জেলার বস্ত্রকলে চলে যেতাম। পরদিন বস্ত্রকল থেকে সুতাভর্তি ট্রাক নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ফিরতাম।
সুতার ব্যবসা করে ১৯৮২ সালের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যান বাদশা মিয়া। ১৯৮৩ সালে একসঙ্গে চার-পাঁচটি বস্ত্রকলের সুতা বিক্রির একক এজেন্ট হোন। তখন একেকটি মিলে এজেন্ট হতে ৫০ লাখ টাকা জামানত দিতে হতো। এজেন্ট হওয়ার পর ব্যবসা আরও দ্রুত বাড়তে থাকে তাঁর। পোশাক কারখানায় সফল হওয়ার পর বস্ত্রকল করার দিকে মনোযোগ দিলেন বাদশা মিয়া। ভালুকায় ১০০ বিঘা জমির ওপর বস্ত্রকল শুরু করেন ২০০৩ সালে। ধীরে ধীরে সেটি আবার বড় হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে হবিগঞ্জে আড়াই শ বিঘা জমির ওপর ডেনিম কাপড় উৎপাদনের কারখানা করেন। সেখানে তাঁর বিনিয়োগ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটীতে নিজের জমিতে ১৯৮৬ সালে পোশাক কারখানা করার পরিকল্পনা করেন।

মেশিনপত্রও কিনে আনেন। শেষ পর্যন্ত সাহস করলেন না। মেশিনপত্র দিলেন বিক্রি করে। আবার দোকানদারিতেই মনোযোগ দিলেন। অবশ্য সেখানে টুস্টিং কারখানা মানে সুতা ডাবলিং বা মোটা করার কারখানা দেন। চাদর বুনতে সেই টুস্টিং সুতার ছিল বেশ কদর। ১৯৮৫ সালে ভাইদের নিজের ব্যবসায় নিয়ে আসেন। তখন কিছুটা স্থির হোন বাদশা মিয়া। পরের বছর ভারত থেকে তুলা আমদানি শুরু করেন। অবশ্য এর আগে সুতা আমদানিতে হাত পাকান বাদশা মিয়া। ধীরে ধীরে টানবাজারের ‘বাদশা’ অর্থাৎ বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন বাদশা মিয়া। আসমা বেগমকে বিয়ে করেন। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় নিজের বাড়ি নির্মাণ হয়ে গেছে। টানা দুবার টানবাজারের সুতা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি। স্কয়ার টেক্সটাইলে প্রথম থেকেই সুতার এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করেছেন বাদশা মিয়া। তার সূত্র ধরেই ১৯৯৭ সালে ঢাকায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন।

১৯৯৯ সালে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটীতে ৪০০ মেশিন দিয়ে সোয়েটার কারখানা করলেন। অবশ্য ১০ বছর পর সেটিকে ভালুকায় স্থানান্তর করেন। বর্তমানে কারখানায় মেশিনের সংখ্যা ২ হাজার। কাজ করেন ১৫ হাজার শ্রমিক। সুতার ব্যবসায় হাত পাকিয়ে বস্ত্রকল করার আগে পোশাকশিল্পে আসার পেছনের কারণ বললেন বাদশা মিয়া। সেটি শুনুন তাঁর মুখেই, ‘পোশাক খাতের পশ্চাৎমুখী শিল্পে ধীরে ধীরে মুনাফা কমে আসতে থাকে। তা ছাড়া পোশাক কারখানার মালিকেরা অধিকাংশই সুতার দাম সময়মতো পরিশোধ করতেন না। সে জন্য একরকম জেদ করেই পোশাক কারখানা করে ফেলি। পোশাক কারখানায় সফল হওয়ার পর বস্ত্রকল করার দিকে মনোযোগ দিলেন বাদশা মিয়া। ভালুকায় ১০০ বিঘা জমির ওপর বস্ত্রকল শুরু করেন ২০০৩ সালে। ধীরে ধীরে সেটি আবার বড় হতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে হবিগঞ্জে আড়াই শ’ বিঘা জমির ওপর ডেনিম কাপড় উৎপাদনের কারখানা করেন। সেখানে তাঁর বিনিয়োগ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

পোশাকের মতো বস্ত্রকলে বিনিয়োগ করার পেছনেও গল্প আছে। বাদশা মিয়া বললেন, ‘ব্যবসা করতে গিয়ে দেখলাম আমরা সুতা বেচে পাই ২ আনা, আর মিলমালিকেরা পান ২ টাকা। তা ছাড়া তখনকার সময়ের সব কটি টেক্সটাইল মিলে ঘুরেছি। তুলা থেকে সুতা উৎপাদনের প্রতিটি স্তর আমার প্রায় মুখস্থ…।’ তবে আসল কারণটা বললেন অনেক পরে, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল শিল্প গড়ব। সেখানে অনেক লোক কাজ করবেন। আমি সব সময় আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। দীর্ঘদিন ধরেই তুলার বড় আমদানিকারক বাদশা মিয়া। ২০১০ সালে ভারতসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তুলা আমদানির চুক্তি করেন। তার পরপরই তুলার দাম বেশ বেড়ে যায়। ভারতের রপ্তানিকারকেরা তুলা না দিয়ে চুক্তিভঙ্গ করলেন। সে সময় সুইজারল্যান্ডের এলডিসি নামের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ঢাকায় এসে বাদশা মিয়াকে বললেন, তুলা দিতে পারবেন না। তবে দাম যেটুকু বেড়েছে, সেই অর্থ দেবেন। বাদশা মিয়া রাজি হয়ে যান। দুই দিনের মধ্যে ৬০ লাখ ডলার ব্যাংকে চলে এল।

তুলা না পেলেও আর্থিকভাবে লাভবান হলেন বাদশা মিয়া। তবে পরের বছরই মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখলেন। প্রতি পাউন্ড তুলা ১ ডলার ৯০ সেন্টে চুক্তি করেছেন। দেশে আসতে আসতে বিশ্ববাজারে তুলার দাম ১ ডলারের নিচে নেমে গেল। দাম পড়ে গেল সুতার। পাক্কা ৩০০ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়লেন। এটিই তাঁর জীবনের বড় হোঁচট। বাদশা মিয়া বললেন, ‘সে সময় চুক্তি অনুযায়ী সুতা না নিয়ে আন্তর্জাতিক কটন অ্যাসোসিয়েশনের কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে নিশ্চিত বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়লেও আমি চুক্তি অনুযায়ী তুলা নিয়েছি। ব্যাংকের কাছেও ঋণখেলাপি হইনি। আসলে ঋণখেলাপি আমার ব্যবসায়িক জীবনের ডিকশনারিতে নেই। বাদশা মিয়া ৬০ বছর বয়সে এসেও দিনে ১৬ ঘণ্টার মতো কাজ করেন।

রাতে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা ঘুমান। প্রায়ই মাঝরাতে ভালুকা বা হবিগঞ্জে চলে যান। সুতা ও ডেনিম কারখানায় দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই উৎপাদন হয়। পুরো কারখানা চক্কর দেন। উৎপাদন দেখেন। তারপর ঘুমাতে যান। হাসতে হাসতে বাদশা মিয়া বলেন, ‘আমি হলাম কামলা (খেটেখাওয়া) মানুষ। কারখানায় কাজ করতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই দিনের জন্য হলেও ভালুকা বা হবিগঞ্জে কারখানায় গিয়ে থাকি।’ অবসর কী করেন জানতে চাইলে বললেন, ‘অবসরেও কাজ করতে পছন্দ করি। ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে গেলেও দেশেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
’বাদশা মিয়া বললেন, ‘আসছি কোথা থেকে? অজপাড়া গাঁ থেকে উঠে এসে শিল্পকারখানা করেছি। হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজির ব্যবস্থা করেছি। আজকের পর্যায়ে আসার পর আমার কোনো অতৃপ্তি নেই। আর কী অতৃপ্তি থাকতে পারে, আপনিই বলেন। আলাপের ফাঁকে হঠাৎ কয়েক লাইন আবৃত্তি করলেন বাদশা মিয়া ‘প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি একা, হেসেছিল সবে। এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।’ বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে এই কথাগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। সেভাবেই জীবনটা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। জানি না কতটুকু পেরেছি…।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2025 Protidiner Kagoj |