বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১৭ পূর্বাহ্ন

ভোরের মক্তব বিলুপ্তির পথে, ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা

ভোরের মক্তব বিলুপ্তির পথে, ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা

মোহাম্মদ শাহ আলম , দাগনভূঞা: ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার সবর্ত্র কালের বিবর্তন, আধুনিকতা ও দ্বীনহীনতার ছোবলে হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম সমাজের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য সকালের মক্তবগুলোতে শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষার হাতেখড়ি হচ্ছে মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা। প্রতিদিন কোমলমতি শিশুরা ফজরের নামাজের পর কিংবা সকালে শীত অথবা গরমকালে সূর্য তার আলোক রস্মী ছড়ানোর আগেই গ্রামাঞ্চলের আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে আরবী শিক্ষার জন্য ছোট ছোট শিশুরা দল বেঁধে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা কিংবা ছোট্ট পরিসরে গড়ে উঠা মক্তব্যগুলোতে দল বেঁধে ছুটে যেত মসজিদে পড়ার জন্য। দোয়া কালাম, নামাজ, কোরআন শিক্ষা ও আদব আখলাক শিখার প্রাথমিক স্তর ছিলো মক্তব।

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ছিল কোরআন শুদ্ধ করে জানে এমন একটি মেয়েই হবে ঘরনী। যাতে বাড়ি-ঘর কোরআনের শব্দে বরকতময় হয়ে উঠে। এখন সেই ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছে মুসলিম সমাজ থেকে। একসময় বাংলার পথে-ঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে মক্তবগামী কোরআনের পাখিদের দেখা মিলত। মুসলিম পরিবারে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতসহ ধর্মীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শেখার অন্যতম ব্যবস্থা ছিলো এটি। ইহকালে শান্তি ও পরকালের নাজাতের শিক্ষার শুরু এই মক্তব থেকেই।

এ শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা। কিন্তু ইদানিংকালে বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কিন্ডার গার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মর্নিং শিফট চালু হওয়ায় একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মক্তবের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে স্কুলে অনেক স্টুডেন্ট ঝরে যাচ্ছে৷ এবছর সবগুলো স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেনে আগের চেয়ে শিক্ষার্থী কমে গেছে।একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকরাও এটি স্বীকার করেছেন। অধিকাংশ মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের সাথে কথা হলে তারা জানায়, প্রতিবছরই মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিক্ষার্থী বাড়ছে৷ প্রতিবছর নতুন নতুন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে।

ভোর থেকে কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা চালু হ্ওয়ায় শিশুরা মক্তবের এই ন্যূনতম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি তাদের কোরআন শেখা তথা দ্বীন শেখার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে তৈরি হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে নীতি-নৈতিকতাহীনতার দিকে ধাবিত হচ্ছে সমাজ। যার ফলে প্রাত্যহিক জীবনে ঘটছে অনাচার-অবিচার, জুলুম, অন্যায়সহ নানাবিদ স্খলনের ঘটনা। ছেলেমেয়েরা হয়ে যাচ্ছে বিপথগামী। বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে এখন অভিভাবকেরা কঁচি-কাঁচা ও শিশু-কিশোরদের মক্তবে পাঠাতে চান না। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা সকালে ঘুম থেকে উঠলেই স্কুল, কোচিং অথবা কিন্ডার গার্টেনে ক্লাসের সময় হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে।

এভাবে চলতে থাকলে আবহমান বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসলামী বুনিয়াদি শিক্ষার এ অবারিত ও ঐতিহ্যগত শিক্ষা ব্যবস্থার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে; চিরতরে হারিয়ে যাবে এবং স্থান পাবে ইতিহাসের পাতায়। তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো বিকল্প পথ বের করা সময়ের দাবি ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় কিন্ডার গার্টেন, ক্যাডেট মাদরাসা, কওমি মাদরাসা ও এতিমখানা, হিফজখানা, কোচিং ব্যবস্থার আড়ালেই হারিয়ে গেছে মক্তব শিক্ষা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাগনভূঞা উপজেলা ৫নং ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো ওয়ার্ডেই এক সময় শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। গ্রামের একাধিক প্রবীণ জানান, মক্তব শিক্ষা বিলুপ্তির কারণে আমাদের দেশে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দিকে শিশুরা ভবিষ্যতে ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে।

যদিও এখনো কোনো কোনো এলাকায় মক্তব শিক্ষা চালু রয়েছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষকরা ছাত্র/ ছাত্রী দের কাছ থেকে মাসে নামেমাত্র জনপ্রতি ৫০/১০০ টাকা পর্যন্ত বেতন হিসেবে নেয়া হয়, যা একেবারেই অপ্রতুল। শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে ৫নং ইয়াকুবপুর ইউনিয়নের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তি হওয়ায় বেতনভাতাদি না নিলে চলা যায় না। আবার অনেক শিক্ষার্থী গরীব প্রতিমাসে বেতন ঠিকমতো উঠে না, বেশিরভাগ বড় লোকের সন্তানদের মক্তবে পড়ান না। বাংলা শিক্ষায় যে বেতন দেওয়া হয় তা ধর্মীয় শিক্ষার বেলায় দেওয়া হয়না। ছাত্র/ছাত্রী দিন দিন কমে যাচ্ছে। শুধু মক্তবে শিক্ষকতা করে সংসার পরিচালনা করা আমাদের কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

একাধিক ছাত্র অভিভাবক বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা একসময় মক্তবে পড়ালেখা করেছি। এখন মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন ঝিমিয়ে পড়ায় আমাদের সন্তানদের কোরআন শিক্ষাসহ ধর্মীয় রীতিনীতির জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর বর্তমানে অসচেতনতার কারণে অভিভাবকরা সন্তানদের মক্তবে না পাঠিয়ে বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষা অর্জনের জন্য কোচিংয়ে পাঠিয়ে দেন। তবে সচেতন মহলের দাবি বাংলা, ইংরেজি, গনিত ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের মূলভাণ্ডার মক্তবের প্রতি যেন গুরুত্ব দেন মুসলিম জাতি। এ ব্যাপারে তরণী ধর্মীয় আলোচক মাওলানা জাকের হোসেন বলেন, অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে৷ দুনিয়ায় শিক্ষার সাথে ধর্মীয় শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়াও এলাকাবাসীকে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। উপজেলার প্রতি গ্রামে অন্তত একটি করে হলেও মক্তব থাকা প্রয়োজন। আগের মতো মক্তব না থাকায় ছেলেমেয়েরা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দিনে দিনে বাড়ছে শিশুশ্রম।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |