শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৯ পূর্বাহ্ন
জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও যুদ্ধবিগ্রহের চাপে বর্তমানে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে৷ সমুদ্রের ঢেউ ও জোয়ারভাটার শক্তি কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে নানা গবেষণা চলছে৷
১৯৭৪ সালে স্কটল্যান্ডের এক প্রোফেসর এমন এক উদ্ভাবন করেছিলেন, যা জ্বালানি ব্যবহারের ইতিহাস বদলে দিতে পারতো৷ সেই যন্ত্রের নাম ‘এডিনবরা হাঁস’৷ অদ্ভুত নাম হলেও ভালো করে নজর দিলে নামের উৎস আন্দাজ করা যায়৷ হাঁসের শরীরের পেছনের অংশ ঢেউয়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দূষণহীন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে৷
গোটা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম ও ব্রিটিশ সরকার এই উদ্ভাবন সম্পর্কে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিল৷ কারণ, এমন আইডিয়ার পেছনে বিশাল সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে৷ সব জায়গাই ঢেউ দেখা যায়, যেগুলোর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় শক্তি জমা রয়েছে৷
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আইডিয়া মুখ থুবড়ে পড়ল৷ পরের কয়েক শতাব্দীর অনেক ভবিষ্যতমুখী উদ্ভাবনের মতো এটিও সাফল্যের মুখ দেখতে পেল না৷
মনে রাখতে হবে, ঢেউয়ের প্রত্যেকটি কণা কিন্তু মহাসাগর অতিক্রম করে না, বরং বাতাসের ধাক্কায় প্রায় একই জায়গায় চক্রাকারে নড়াচড়া করে৷ তার ফলে যে শক্তি সৃষ্টি হয়, সেটি পরের কণায় স্থানান্তরিত হয়৷
ঢেউয়ের উপরিভাগে সবচেয়ে শক্তিশালী সঞ্চালন ঘটে৷ গভীরতা বাড়লে সেই শক্তি কমতে থাকে৷ ঢেউয়ের গতিবিধি বেশ জটিল হলেও এর পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব৷ বাতাস সম্পর্কে স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য সেই কাজে সহায়তা করে৷
ঢেউ থেকে জ্বালানি উৎপাদন করার একাধিক উপায় রয়েছে৷ যেমন পয়েন্ট অ্যাবসর্বার ব্যবহার করা যায়৷ সেটি পানির ওপর ভাসে এবং সব দিক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে৷ সমুদ্রের নিচের মাটিতে নোঙর করা থাকে বলে নড়চড় হয় না৷ বয়া ও স্থায়ী অংশের মধ্যে সঞ্চালনের ফলে ভেতরের পিস্টন একটি জেনারেটর চালায়৷
সারফেস অ্যাটেনুয়েটারও কাজে লাগানো যেতে পারে৷ একাধিক অংশ নিয়ে তৈরি এই যন্ত্র ঢেউয়ের মুখে খাড়া হয়ে থাকে৷ ঢেউয়ের ধাক্কায় অংশগুলোর মধ্যে সঞ্চালনের ফলে শক্তি সৃষ্টি হয়৷
অসিলেটিং ওয়াটার কলাম বা স্তম্ভও সেই কাজ করে৷ ফাঁপা এই যন্ত্রের কিছু অংশ পানির নিচে থাকে৷ প্রত্যেকটি ঢেউ ভেতরের বাতাস চেপে ধরে, যার ফলে এক টার্বাইন ঘুরতে থাকে৷
হাঁসটি সারফেস অ্যাটেনুয়েটারের মতো কাজ করে৷ ১৯৭৩ সালের পেট্রোলিয়াম সংকটের ফলে অভাব মতেই সেটি তৈরি করা হয়েছিল৷ কিন্তু সেটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগেই পরমাণু বিদ্যুৎ জনমানসে বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছিল৷ হাঁসটি সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি৷
আজও সত্তরের দশকের মতো জ্বালানি সংকট দেখা যাচ্ছে৷ কার্বন নির্গমন শূন্যে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে৷ অথচ বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে৷ ২০৪৫ সালের মধ্যে সেই চাহিদা আনুমানিক ৩০ শতাংশ বেড়ে যাবে৷
এমনই প্রেক্ষাপটে জোয়ারভাটা ও ঢেউ থেকে জ্বালানি উৎপাদন আবার গুরুত্ব পাচ্ছে৷ কারণ, শীতকালের অন্ধকার দিনগুলোতে সূর্য না দেখা গেলে এবং বাতাস না বইলে জ্বালানির বিকল্প উৎসের প্রয়োজন হবে৷
ঢেউ সম্পর্কে শুধু আগাম আভাস পাওয়া যায় না, সারা বছর ঢেউ নির্ভরযোগ্যভাবে সমুদ্রে গতি আনে৷ উইন্ড টার্বাইনের তুলনায় ওয়েভ এনার্জি প্লান্ট আরও অনেক গুণ বেশি জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে৷ বাতাসের তুলনায় পানির ঘনত্ব কয়েকশ’ গুণ হওয়ায় এমনটা ঘটে৷
২০২১ সালে ইউরোপে তার আগের বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি ঢেউচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে৷ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো জোয়ারভাটা ও ঢেউয়ের শক্তি পেছনে মোট প্রায় সাত কোটি ইউরো বিনিয়োগ করেছে৷
কাগজেকলমে ঢেউয়ের শক্তির পরিমাণ বিশ্বব্যাপী চাহিদার প্রায় তিন গুণ বেশি৷ বাস্তবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত এর অনুপাত প্রায় দশ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
বর্তমানে ঢেউয়ের শক্তি কাজে লাগানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লান্টটি স্কটল্যান্ডে চালু হয়েছে৷ প্রবল বাতাস, বিশাল ঢেউ ও ওয়েভ এনার্জি নিয়ে গবেষণার এমন দীর্ঘ ঐতিহ্য অন্য কোথাও দেখা যায় না৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুশক্তির তুলনায় ঢেউয়ের শক্তি এখনও প্রায় ২০ বছর পিছিয়ে রয়েছে৷ অদূর ভবিষ্যতে বায়ু বা সৌরশক্তিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ৷ কিন্তু অফশোর প্ল্যাটফর্মের মতো বিশেষ কিছু বাজারের জন্য এই উৎস আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে৷
নির্গমনহীন জ্বালানির পথে ঢেউচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ভালো সমাধানসূত্র হতে পারে৷ সেই লক্ষ্যে পরীক্ষানীরিক্ষা চলছে৷
কর্মক্ষমতা ও ব্যয়ের নিরিখে বর্তমানে ওয়েভ এনার্জি অন্যান্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে৷ তবে ভবিষ্যতের ‘এনার্জি মিক্স’-এর অংশ হিসেবে এই উৎস অনেক সুবিধা বয়ে আনতে পারে৷
সৌজন্যে : ডয়চে ভেলে