সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এলাকা থেকে ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর ২ হাজার পিস ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক জোহর আলম। জিজ্ঞাসাবাদে জোহর আলম তার নিজের নাম-ঠিকানার পরিবর্তে টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার বাসিন্দা নুরুল বশরের ঠিকানা দেন। এ মামলায় জোহর আলম ২০২০ সালের ১২ মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। জামিনে ২৩ মার্চ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গা ঢাকা দেন।
এরপর চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে বিভাগীয় দ্রুত বিচারক আদালত মামলার রায়ে আসামিকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন। রায়ের সময় আসামি পলাতক ছিলেন। নিয়মানুযায়ী নুরুল বশরের নামে থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
এ ঘটনায় জালিয়াতির রহস্য উদঘাটন এবং এর সঙ্গে জড়িত জোহর আলমসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক এবং চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ আদালত আজিজ আহমেদ ভূঞার আদালতে আবেদন করেছেন নুরুল বশর। আদালত আগামী ১০ অক্টোবর নিয়মিত আদালতে শুনানির জন্য বলেছেন।
ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নুরুল বশরের আইনজীবী সেলিম উল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, নুরুল বশরের নাম ঠিকানা জালিয়াতি করে ব্যবহার করেছেন মূল আসামি জোহর আলম। এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে ও ঘটনার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত এর রহস্য উদঘাটনের জন্য আদালতে আবেদন করেছি। আগামী ১০ অক্টোবর নিয়মিত আদালতে শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে না থেকে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ২০১৭ সালে জোহার আলমের সঙ্গে আমার মক্কেলের মারামারি হয়। এতে নুরুল বশরের মানিব্যাগ হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগে তার পরিচয়পত্রের ফটোকপি ছিল। পরে ২০১৮ সালে জোহর আলম ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর জোহর নিজের রোহিঙ্গা পরিচয় গোপন করে। সেই সঙ্গে আমার মক্কেল নুরুল বশরের জাতীয় পরিচয়পত্রে যে নাম ঠিকানা ছিল সেগুলো ব্যবহার করে জোহর। এরপর তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে পালিয়ে যান। মাদক উদ্ধারের মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়। ১০ বছর সাজা হওয়ার পর নুরুল বশর বিষয়টি জানতে পারেন। নুরুল বশর কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকার পরও ১০ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন।
জানা গেছে, মূলত রোহিঙ্গা নাগরিক জোহর আলম দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে। পরিচয় গোপন করতে নিজের নাম-ঠিকানা হিসেবে নুরুল বশরের ঠিকানা দেওয়া হয়। আটক হওয়ার আগে বশরের পাড়ায় দিনমজুরের কাজ করার সুবাদে নুরুল বশরের সঙ্গে পরিচয়, তারই সূত্রে নুরুল বশরের নাম-ঠিকানা জানতো মাদকের কারবারি জোহর আলম।
তিনি মিয়ানমারের বুচিডং স্ট্যাট চিংডং এলাকার সৈয়দ হোসেনের ছেলে। বর্তমানে কক্সবাজারের টেকনাফ থানার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন ২ নম্বর ওয়ার্ড বালুখালি সৈয়দের বাড়ির বাসিন্দা। অপরদিকে নুরুল বশরও কক্সবাজারের টেকনাফ থানার হোয়াইক্যং ইউনিয়ন ২ নম্বর ওয়ার্ড বালুখালির বাসিন্দা।
আদালত, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও থানা সূত্র জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাঙ্গুনিয়ার থেকে জোহর আলমকে ২ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে জোহর নিজের নাম গোপন রেখে নুরুল বশরের নাম, বাবা ও মায়ের নামসহ পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ব্যবহার করে। কিন্তু নুরুল বশরে আইডি কার্ডে নাম নুরুল বশর থাকলেও মামলার এজাহার, অভিযোগ পত্র ও মামলার রায়ে মো. নুরুল বশর উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে নুরুল বশরের বাবার নাম এনআইডি কার্ডে সৈয়দ কাসিম থাকলেও মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও মামলার রায়ে সৈয়দ কাশেম উল্লেখ করা হয়েছে। মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে- কুলসুমা বেগম।
ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী উপ-পরিদর্শক মুহাম্মদ খোরশেদ আলম বাদী হয়ে রাঙ্গুনিয়া থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জীবন চাকমা ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
এদিকে, গত ৬ আগস্ট জোহর আলমকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করে টেকনাফ থানা পুলিশ। বর্তমানে জোহর কক্সবাজার কারাগারে বন্দি রয়েছেন বলে জানা গেছে ।
আদালত প্রাঙ্গণে নুরুল বশর ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে টেকনাফের দর্জির দোকানে কাজ করেছি। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ও মামলা নেই। প্রয়োজনে আমার এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। বাড়ির পাশে দর্জির কাজ করে আমার পরিবার চলে। কোনদিন কোনো অনৈতিক কাজে নিজে জড়ায়নি। কিন্তু সম্প্রতি কারাগারে থাকে বের হয়ে আসা আমার প্রতিবেশী আব্দুল আলিমের মাধ্যমে জানতে পারি ঘটনাটি। তিনি আমাকে বলেন, মিয়ানমারের নাগরিক জোহর আলম আমার নাম ব্যবহার করে হাজতবাস ও জামিন লাভ করেন। ঘটনাটি আমি ৫ মাস আগে তার মাধ্যমে জানতে পারি।
তিনি বলেন, প্রথমে আমি বিষয়টি বিশ্বাস করিনি। জোহর আলম কারাগার থেকে জামিন পেয়ে বের হলে তাকে জিজ্ঞাস করলে বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। থানায় খবর নিয়ে জেনেছি, আমার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। বিনা অপরাধে আমার নামে পরোয়ানা দেওয়া হয়েছে। আমি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার চাই। ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই।
তিনি বলেন, জোহর আলম তিন-চার বছর ধরে আমাদের এলাকায় কাজ করতেন। তার সঙ্গে ২০১৭ সালে আমার মারামারি হয়েছিল। তখন আমার একটি ব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিল। তখন জাতীয় পরিচয়পত্রসহ ব্যাগটি হারিয়ে যায়। তখন জোহর আলম হয়তোবা আমার পরিচয় পত্রটি পেয়েছিল। জোহর আলম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন অন্য একটি মামলায়। সে যেন কারাগার থেকে বের হতে না পারে।
জোহর আলম অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগের একটি ভিডিও ঢাকা পোস্টের কাছে সংরক্ষিত আছে। সেখানে জোহর আলমকে বলতে শুনা যায়, ‘আমি হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করতাম। নুরুল বশরের বাড়িতে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। আমি লোভে পড়ে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। পরে এক পর্যায়ে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছি। মারধরের ভয়ে আমি নাম ভুল দিয়েছি। নিজের নাম গোপন করে নুরুল বশরের নাম বলেছি।
গ্রেপ্তারের পর তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি বার্মার কি না। আমি ভয়ে বাংলাদেশি বলেছি। পরিচয় দিয়েছি- নাম মো. নুরুল বশর, বাবা সৈয়দ কাশেম, মা কুলসুমা বেগম। নুরুল বশর পরিচিত। আমি হিসাব করেছি, জেল থেকে কেউ মোহাব্বত করলে বের হতে পারবো। না হয় নুরুল বশর নামে জেলে জীবন কাটিয়ে দিতাম। আমি তো দোষী।