শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৭ অপরাহ্ন

আপডেট
বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও ভৌগলিক অবস্থান

বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও ভৌগলিক অবস্থান

বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ও ভৌগলিক অবস্থান

মুহাম্মদ আমির হোছা্ইন :

ভৌগোলিক অবস্থানে মানুষকে তাঁর কর্মকান্ড ও কীর্তিলাপ ,সংস্কৃতি কর্মকান্ড সম্পাদন করে।ভৌগলিক অবস্থান ,শ্রেণি,বংশ,ধর্ম,ভাষা,সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে মানুষের আত্মপরিচয়। ভূগোল ইতিহাসের ভিত্তি হয়ে একটি জাতির আত্মপরিচয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। একই ভৌগলিক সীমানায় বসবাসরত সমগ্র জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধ ও ইতিহাসের ওপর অন্যকোনাে ভৌগােলিক সীমানারেখায় অবস্থিত মানুষের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিচালনা করা হল জাতীয়তাবাদ।

এ জাতীয়বাদ চেতনা পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকাশে একটি রাজনৈতিক দর্শন হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে সময়ে পৃথিবীতে জুড়ে জাতীয়তাবাদের বসন্ত শুরু হয়েছিল । এসময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে জাতি সত্তার ভিত্তিতে অনেক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। ওই সব জাতি পরাধীনতা ও শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা থেকে মুক্তি চেয়েছে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি যদি শক্তিশালী না হয়, সেই রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না।

স্বাধীনতা, স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র গঠনে জাতীয়তাবাদী আদর্শের সফলতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষের জাতি-পরিচয়-শক্তিকে খাটো করে দেখা অনুচিত,জাতীয়তাবাদী আদর্শ অর্থনৈতিক মুক্তি ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রবল ইচ্ছাকে জাগ্রত করে । ভারতে ইংরেজ আগমনের পূর্বেই এ জনপদে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিদ্যামান ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব এবং শাসন থেকে ভারতের সর্বভারতীয় মিলিত আন্দোলন জাতীয়বাদী চেতনায় রূপ নেয় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের প্রভাব ভারতীয়দের মাঝে প্রবলভাবে বিস্তার করছিল। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে কংগ্রেস অহিংস আন্দোলনের নীতিমালা অবলম্বন করেছিল এবং অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী নেতৃত্ব দিয়েছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’র মত অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পরবর্তীকালে একটি বৈপ্লবিক দর্শন অবলম্বন করে আন্দোলনে করতে এসেছিলেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ সে সময় সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে যত ক্ষুদ্রই হোক একটি ভিন্ন ধারা স্থান করে নিয়েছিল বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ। সেটি ছিল অখণ্ড বাংলাকে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা।

ইতিহাসের পরিক্রমায় চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু ১৯৭১-এ,মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সফলতা লাভ করে। জাতীয়তাবাদ এর মৌলিক উপাদান ভৌগোলিক অবস্থান,ভাষা, সাহিত্য। বাঙালিদের ভৌগলিক অবস্থান এর বিস্তৃতি কতটুকু ? বাঙালি হল একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি , দক্ষিণ এশিয়াতে বসবাসরত প্রাচীন জাতি, তথা বাংলা ভাষাগত অঞ্চলের অধিবাসীদের বুঝানো হয়।

প্রাচীন যুগে বাংলা বলতে সমগ্র বাংলাকে না বুঝালেও এ কটি বিশাল ভূমিকে বোঝায় ,এ ভূমির বিভিন্ন জনপদের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নামানুসারে নাম পরিচিত লাভ করছিল। যা ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন,বরেন্দ্র, সুহ্ম ও রাঢ়,গৌড়,বঙ্গ মত আরো ক্ষুদ্র অনেক জনপথ। ইতিহাসে পাওয়া যায় ‘বঙ্গ’ উপজাতীয় নাম হিসেবে। ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্হে, বঙ্গদের কথা বলা হয়েছে,যারা আর্য সভ্যতা বহির্ভূত কলিঙ্গদের প্রতিবেশী বলে উল্লেখ আছে।

১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে “বাংলা বলতে এক বিস্তৃত ভূ-খন্ডকে বোঝাত। এই বাঙ্গালার ভৌগোলিক অবস্থান ও ইতিহাসের স্বীকৃত। বাঙালি জাতি উপমহাদেশের একটি অন্যতম জাতীয়তাবাদী চেতনায় প্রভাবিত এক প্রভাবশালী জাতি। বাঙালি জাতিকে উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের রূপকার বলা হয়ে থাকে। অবিভক্ত বাংলা পরবর্তীতে ব্রিটিশ চক্রান্তে বিভক্ত করা হয়। প্রাচীন বঙ্গদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানব সম্প্রদায়ের একতাবদ্ধ পরিচয়কে বাঙালি বলা হয়, যাদের ইতিহাস অন্তত চার হাজার বছর পুরোনো।

এদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলার সীমানা নির্ধারণ নদীবিধৌত পলিল গঠিত বিশাল বিস্তৃত এক সমভূমি পূর্বেই ত্রিপুরা,গারো,ও লুসাই পর্বতমালা,উত্তরে শিলং,ও নেপাল তরাই অঞ্চল ,পশ্চিমে রাজমহল ও ছোট নাগরপুর এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এ সমভূমির দক্ষিণ দিকে সাগর অভিমুখে ঢালু এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার বয়ে আনা বিপুল পলিতে গঠিত নিন্ম সমভূমি।পশ্চিম,উত্তর ও পূর্বদিকের সীমান্তের পর্বতমালা ছাড়া বাকি সব সমভূমি ব-দ্বীপ। পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে পূর্বে মেঘনা পর্যন্ত এ ব-দ্বীপ অবস্থান।

এই সমতলভূমির মধ্যে ত্রিপুরা নিকটবর্তী প্লাবন ভুমি থেকে উঁচু ভূমি এর মাঝামাঝি ময়নামতি পাহাড় এর দক্ষিণ সীমান্ত অবস্থিত প্লাইসটোসিন যুগে মধুরপুরের উচ্চভূমি।এই ভূ-খন্ড হল.. বাঙ্গালীর কর্ম ভূমি। নীহারঞ্জন যথার্থ বলেছেন , ‘এই ভূ-খন্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালির কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নর্মভূমি। এক দিকে সুউচ্চ পর্বত,দুইদিকে কঠিন শৈলভূমি আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য- ইহাই বাঙালির ভৌগোলিক ভাগ্য। এই ভূমি পৃথিবীতে বাঙালিকে দিয়েছে আলাদা সম্মান,সংস্কৃতিক পরিচয়।বাংলার প্রাচীন জনপদ পুণ্ড্র,রাঢ়,বঙ্গ বা সংমতট, এ গুলো নদীর প্রবাহ কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ।

এভাবে মোগল যুগে অনেক ভৌগোলিক সত্তা মিলে নাম রাখেন ‘সুবাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ আর ইংরেজ আমলে ‘বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ছিল। আবুল ফজল এ সুবা বাঙ্গালাহ’র আদি নাম ‘বঙ্গ’ । আর এ পর্তুগীজ কাছে ‘বেঙ্গালা’ নামে পরিচিত ছিল। কৃষি প্রধান বাংলার জনপদ হলো যেন নদীর দান। নদীর প্রবাহ কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ নগর আর বন্দর । কালের পরিবর্তনে জনপদগুলো সাম্রাজ্যবাদের দুঃশাসন অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় হারিয়ছে সমৃদ্ধি গৌরব। সাম্রাজ্যবাদী কবলে পড়ে ভিন্ন-ভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সম্প্রসারণ সংকোচনে গড়ে ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রভাব।

কেউ এক জনপদ অন্য জনপদে বিচ্ছিন্ন রয়ে গড়ে তুলেছে স্বকীয় সংস্কৃতি। কখনো রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে এদেশে মানুষের মনোভাবে স্থান করে ভিন্ন ধর্ম । তবে রাজনৈতিক শক্তি উত্থান-পতনে ভৌগলিক সত্তা একে-একে লুপ্ত হয়ে নতুন প্রসাশনিক নামে নতুন পরিচয়। সেই অবিভক্ত অঞ্চলে, বাংলা ও বাঙালি, এই দুটি শব্দ প্রায় সমার্থক ছিল। সেখানে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা আলাদাভাবে উচ্চারিত হত না। বরং, এই সাধাসিধে সহাবস্থানের ধারণার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল জাতি-সম্প্রদায় ও এক সামাজিক অনুশাসনের ধারণা।

সবশেষে ইংরেজরা তাদের শাসনের সুবিধায় দুইটি আলাদা অঞ্চলে পৃথক করে দেয়।এক. বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে বিরাট অঞ্চল নিয়ে দুই, পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নতুন এক প্রদেশ তৈরি করে হিন্দু-মুসলমান বাঙালির মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হলে ব্রিটিশ ভারতে দুটি স্বাধীন দেশ ভারত ও পাকিস্তান নতুন পরিচয়ে পরিচিত হল।

ভারত যুক্ত হল পশ্চিম বঙ্গ ; পাকিস্থানে চলে গেল বর্তমান স্বাধীন পূর্ববঙ্গ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

লেখক : মুহাম্মদ আমির হোছা্ইন, সাব এডিটর দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ ।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |