শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন

আপডেট

খোকা থেকে জাতির পিতা

খোকা থেকে জাতির পিতা

ড. আব্দুল্লাহ-আল-বাকী : আজ থেকে ৫২ বছর পূর্বে পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে বাঙ্গালী জাতী যখন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিল শুধু প্রয়োজন ছিল একটি ঘোষণার, একটি আহ্বানের, একজন যোগ্য নেতৃত্বের ঠিক তেমনি এক মুহুর্তে বাংলার স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহাকবি, বাংলার ইতিহাসের নির্মাতা জাতির পিতা শেখ মুজিব বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ রচনা করেছিলেন। মাত্র ৫৫ বছরের ব্যবধানে এই বাংলার এক অজপাড়া গাঁয়ের খোকা হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, আর বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা।

তাঁর বজ্রকণ্ঠ, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা এবং জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতা তাকে এক বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে। মহানায়ক মহাকবি সবযুগে সবকালে সৃষ্টি হয় না। কালের বিবর্তনে যুগের পরিক্রমায় দু-একজনের আবির্ভাব ঘটে। ইতিহাস তার প্রয়োজনেই তার তাগিদেই মহানায়কের আবির্ভাব ঘটায়। আর সেই মহানায়কই হয়ে উঠেন একটি জাতির মুক্তির কান্ডারী, একটি জাতির ইতিহাস রচনার প্রধান স্থপতি ও প্রধান কারিগর। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই কালজয়ী মহাপুরুষ, যিনি বাংলার স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের মহাকবি। তিনি বাঙ্গালী জাতিকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন সেই কালজয়ী মহাপুরুষ! ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনষ্টন চার্চিল বলেছিলেন, We shall fight মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন “We have a dream” ভারতের কিংবদন্তি নেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দিব।” আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত পেট্রিক হেনরি বলেছিলেন, “We have a dream” । আর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ”।

তিনি তার অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দিয়ে সেই কাজটি করতে পেরেছিলেন, করেছিলেন বাঙ্গালী জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। বাঙ্গালী জাতীর কাছে তিনি পিতা। জনগণের কাছে তিনি বন্ধু। বিদেশীদের কাছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের মুখপাত্র। ব্রিটেনের মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতা লর্ড ফেনার ব্রোকওয়ে বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু এক অর্থে জজ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধি, দ্যা ভ্যালেরার চেয়েও বড় নেতা। ব্রিটিশ সাংবাদিক সিরিল ডান বলেছিলেন বাঙ্গালী হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে ও জন্মসূত্রে পুরোদস্তুর বাঙ্গালী। বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী জাতি এবং বাংলা ভাষাকে মনে প্রাণে ভালবাসতেন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন বাঙ্গালী জাতি ও বাংলা ভাষার মর্যাদা তিনি রক্ষা করেছেন। তিনি যে একটা ছোট্ট দেশের প্রেসিডেন্ট এইটা কখনও তার চিন্তার মধ্যে ছিল না।

১৯৭৩ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে মৃত ৪ জনের নামে তোরণ হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ন, মিসরের জামাল আব্দুল নাসের, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা ও ভারতের পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু যারা এই নন এলায়েন্স কনফারেন্সের স্থপতি ছিলেন। আর জীবিত ২ জনের নামে তোরণ হয়েছিল একজন জোসেফ মার্শাল টিটো আরেকজন বাংলার নেতা শেখ মুজিব।

জাতিসংঘে অ্যারাবিক, স্পেনিশ, ফ্রান্স, রাশিয়ান এবং ইংরেজি এই ৫টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বাংলা ভাষার মর্যাদা দিতে গিয়ে তিনি ৪৫ মিনিট বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিলেন, সেখানে তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং বঞ্চিত মানুষের কথা বললেন। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে দাড়িয়ে বলেছিলেন, “সমগ্র বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত : শাসক এবং শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। শোষিত বিশ্বকে আমাদের বাঁচাতেই হবে।” বক্তৃতা শেষে ১৫ মিনিট করতালি হল। তুমুল করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল সেইদিনের সম্মেলন কক্ষ। বক্তৃতার পরে তানজিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ার মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে বললেন, “তুমি শুধু বাঙ্গালী জাতির নেতাই নও। এমন একদিন আসবে, যেদিন তুমি তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের নেতৃত্ব দিবে।” কিউবার বিপ্লবী মহানায়ক রাষ্ট্রপতি ড. ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, “মুজিব, চমৎকার আপনার বক্তব্য। চমৎকার আপনার প্রতিভা। শোষক বিশ্বের বিরুদ্ধে এ বাঁচার সংগ্রামে আমিও আপনার অংশীদার।” তারপর সেই বিখ্যাত উক্তি, “I have not seen the Himalayas but I have not seen Sheikh Mujib in personality and in courage this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas” [আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্বে ও সাহসে লোকটি হিমালয়ের সমান। এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।]

আজ ১৫ই আগষ্ট বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলংকজনক অধ্যায়। এই দিন সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ও জঘন্যতম হত্যাকান্ড। বাংলার মাটিতে রচিত হয়েছিল বেঈমানীর ইতিহাস। ১৫ই আগষ্ট তারিখে কিছু নরপশু তার বুকে গুলি চালিয়েছে। তারা জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে নি। তিনি তার আদর্শের মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন। সক্রেটিস বিষের পাত্র হাতে বলেছিলেন, তোমরা আমার মৃত্যু ঘটাচ্ছো না। আমাকে অমরত্ব দান করেছ। সক্রেটিসের এই কথাটি বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও প্রযোজ্য। তিনি ছিলেন নশ্বর মানুষ। মৃত্যু তার একদিন হতোই। কিন্তু ঘাতকের বুলেট
তাকে চির অমরত্ব দান করেছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ শেখ মুজিব। আর ঘাতকের দল মানুষের ঘৃণা আর অভিশাপ নিয়ে কবরে শায়িত। যারা ১৫ই আগষ্টকে উৎসবে পরিণত করেছিলেন দেশি বিদেশী চক্রান্তের ফল হিসাবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে খুশী করার জন্য যারা ইতিহাসের ভয়াবহ জঘন্যতম এবং নজিরবিহীন হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিলেন তাদের জন্ম পরিচয় সম্পর্কে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলতে চাই “যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবানী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন’ জানি।” ঐদিন ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক কালজয়ী মহাপুরুষ। কবি শামসুর রহমানের ভাষায়-
“ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর
পতাকার মত দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর
ঝরে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।
কবির ভাষায় “ধন্য সেই পুরুষ
যার নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া
ধন্য সেই পুরুষ
যার নামের উপর পাখা মেলে দেয় জোৎস্নার সারস।”

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |