শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২১ পূর্বাহ্ন

আপডেট
এমপি আনারকে হত্যার পর মদ খেয়ে উল্লাস করে খুনিরা

এমপি আনারকে হত্যার পর মদ খেয়ে উল্লাস করে খুনিরা

এমপি আনারকে হত্যার পর মদ খেয়ে উল্লাস করে খুনিরা

ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পর উল্লাসে মত্ত হয়ে উঠেছিল খুনিরা। এমপি আজীমকে ‘হানি ট্র্যাপে’ ফেলে ‘সঞ্জীবা গার্ডেন’ নামে আবাসিকের একটি ফ্ল্যাটে নেওয়ার পর ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করে তাকে অচেতন করা হয়। অচেতন অবস্থায় এ ঘটনায় গ্রেফতার তরুণী সিলিস্তা রহমানের সঙ্গে এমপির নগ্ন ছবি তোলার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। তবে ক্লোরোফর্মের মাত্রা বেশি হওয়ায় এতে সফল হয়নি তারা। পরে বালিশ চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে মদ ও হেরোইনের আসর বসায় তারা। লাশের পাশে বসেই মদ ও হেরোইন সেবন করে উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। এরপর এমপির মরদেহের মাংস ও হাড় আলাদা করা হয়। মাংস ‘কিমা’ বানিয়ে ফ্ল্যাশ করা হয় বাথরুমের কমোডে। আর হাড় ও মাথার খুলি নেওয়া হয় বাইরে। সেগুলো ফেলা হয়েছে নিউ টাউন এলাকা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বের হাতিশালার বর্জ্য খালে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে মাহমুদ হাসান শিমুল, সিলিস্তা রহমান ও ফয়সাল আলী ওরফে সাজিকে আদালতে সোপর্দ করে আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল অনেক তথ্য দিয়েছে। এখন রিমান্ডে নিয়ে নিবিড়ভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের দেওয়া তথ্য খতিয়ে দেখার পাশাপাশি এই ঘটনায় জড়িত পলাতক খুনিদের গ্রেফতারেও অভিযান চালানো হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার আব্দুল আহাদ বলেন, ‘আসামিদের আট দিনের রিমান্ড হয়েছে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তারা যেসব তথ্য দিচ্ছে, তা যাচাই-বাছাই করা হবে। হত্যাকাণ্ডের কারণ ও অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আমানুল্লাহ জানিয়েছে, এমপি আজীমকে তারা খুনের পরিকল্পনা নিয়েই কলকাতায় গিয়েছিল। কিন্তু খুনের আগে তার কাছ থেকে কিছু অর্থ আদায় করা যায় কিনা, এজন্য ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টাও করেছে। এজন্য সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে তাকে নেওয়ার পর ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করা হয়। এরপর সিলিস্তার সঙ্গে এমপির নগ্ন ছবি তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু অধিকমাত্রায় ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয় গভীরঘুমে অচেতন হয়ে পড়েন এমপি আজীম। পরে ব্ল্যাক মেইলের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

আমান ওরফে শিমুল জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, এমপি আজীমকে হত্যার সময় ওই কক্ষে তার সঙ্গে ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম এবং জুবেইর ওরফে জিহাদ হাওলাদারও উপস্থিত ছিল। তারা এমপির লাশের পাশে বসেই মদ ও হেরোইন সেবনের আসর বসায়। মদ ও হেরোইন সেবন করে লাশ টুকরো টুকরো করে। মরদেহের হাড় থেকে মাংস আলাদা করে জিহাদ ও সিয়াম। এই জিহাদ ও সিয়াম আক্তারুজ্জামান শাহীনের ঘনিষ্ট সহযোগী। তারা আগে থেকেই কলকাতায় অবস্থান করছিল।

আমান ওরফে শিমুলের ভাষ্য, তারা প্রথমে এমপি আজীমের লাশ গুমের জন্য হাড়-মাংস আলাদা করে। হাড়-মাংস ট্রলি ব্যাগের মাধ্যমে বাইরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাংসগুলো কিমার মতো বানিয়ে বাথরুমের কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করা হয়। পড়ে হাড় ও মাথার খুলির একটি ব্যাগ নিয়ে সে একটি শপিংমলের সামনে সিয়ামের কাছে দেয়। সিয়াম ও জিহাদ মিলে সেগুলো ফেলে দেয়।

ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার জিহাদ জানিয়েছে, সিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে তারা এমপি আনারের হাড় ও খুলি নিয়ে ভাঙর এলাকায় জিরেনগাছা ও কৃষ্ণমাটি ব্রিজের কাছে বাগজোলা খাল পাড়ের নির্জন জায়গায় ছুড়ে ফেলেছে। তার দেওয়া তথ্য মতে, ভারতীয় পুলিশ দুদিন ধরে সেই খালে তল্লাশি চালিয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় পুলিশ ওই খাল থেকে কিছু হাড় উদ্ধার করেছে, কিন্তু সেগুলো এমপি আজীমের কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এজন্য সেগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তারা মাথার খুলি উদ্ধারের জন্য জোরদার অভিযান চালাচ্ছেন।

তল্লাশি
জিহাদকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির তল্লাশি
বাংলা ট্রিবিউনের কলকাতা প্রতিনিধি রক্তিম দাশ জানিয়েছেন, জিহাদের দেখানো মতো জায়গায় শুক্রবারও ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালানো হয়।কিন্তু দুই ঘণ্টার উপরে তল্লাশি চালিয়েও সিআইডির টিম কিছুই খুঁজে পায়নি। সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু রাতের অন্ধকারে জিহাদের অপরিচিত, ওই জায়গায় ঠিক কোথায় মৃতদেহের টুকরো ছুঁড়ে ফেলেছিল; তা নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। কখনও সে বলছে, বাঁশ গাছের পাশ দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছি। আবার কখনও বলছে, জঙ্গলে দাঁড়িয়ে প্লাস্টিক প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলেছি। দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় কিছু না পেয়ে সিআইডি টিম এদিন ফিরে যায়। শনিবার আবার ওই এলাকায় তল্লাশি চালানো হবে বলে সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাকারবারি ও বন্ধু শাহীনের সঙ্গে অন্তত ২০০ কোটি টাকা লেনদেনের বিরোধের জের ধরে হয়েছে বলে ধারণা করছেন। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে সোনা পাচারকারী চক্রের মূল হোতা কয়েক জনের সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে একজন সীমান্ত এলাকার একজন স্বর্ণ চোরাকারবারি ও ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ের নেতা। বিগত জাতীয় নির্বাচনে তিনি এমপি প্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু ভোটে হেরে গেছেন। আরেকজন একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী জুয়েলারি ব্যবসায়ী। তার বাড়িও সীমান্ত এলাকার একটি জেলায়। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে তারা নিয়মিত স্বর্ণ পাচার করেন।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এমপি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি অনেক বড়। সম্প্রতি সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচিত কোনও এমপিকে হত্যার মতো ঘটনা আর ঘটেনি। এই ঘটনার সঙ্গে বড় বড় মাফিয়া এবং শত শত কোটি টাকার লেনদেন জড়িত। এজন্য নিবিড়ভাবে তদন্ত করে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।

আদালতে দেওয়া ফরোয়ার্ডিংয়ে আলোচিত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা ওয়ারী বিভাগের সংঘবদ্ধ গাড়ি চুরি টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, পূর্ব পরিকল্পনার অংশ অনুযায়ী আলোচিত এই খুনের মূলহোতা আক্তারুজ্জামান শাহীন ভুক্তভোগী এমপি আনোয়ারুল আজীমকে ব্যবসায়িক মিটিং করার কথা বলে কলকাতায় যেতে বলে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এমপি আজীম কলকাতায় যাওয়ার আগেই শাহীন ১০ মে দেশে চলে আসে। তবে শাহীনের দেশে ফেরার বিষয়টি ভিকটিম জানতো না। দেশে ফেরার আগে শাহীন ভাড়াটে কিলার আমানুল্লাহ সাঈদকে দায়িত্ব দিয়ে আসে; কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয় এবং কোনও প্রমাণ না থাকে।

গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত কোনও এমপি বিদেশে গেলে সঙ্গে একজন ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে নিয়ে যান। চোরাকারবারি ব্যবসা নিয়ে বৈঠকের জন্য এমপি আনার একাই ভারতে গিয়েছিলেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন এমপি আনারকে একাই ভারতে যেতে বলেছিলেন। তাকে বৈঠকের পাশাপাশি সিলিস্তা রহমানকে দিয়ে ‘হানি ট্র্যাপ’ করা হয়েছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা আক্তারুজ্জামান শাহীন ঘটনার পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। গত ১৮ মে তিনি প্রথমে ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে নেপাল যান। পরে সেখান থেকে দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন। শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তাকে ধরতে পুলিশের এনসিবি বিভাগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থার কাছে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তবে গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, শাহীনকে দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকায় এটি সম্ভব হবে না। তারপরও আলোচিত ঘটনার জন্য তাকে ফেরাতে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করা হবে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |