শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৬ পূর্বাহ্ন

আপডেট
ময়মনসিংহে ওসিদের ‘ঘুষের’ টাকায় স্ত্রীরা কোটিপতি!

ময়মনসিংহে ওসিদের ‘ঘুষের’ টাকায় স্ত্রীরা কোটিপতি!

ময়মনসিংহে ওসিদের 'ঘুষের’ টাকায় স্ত্রীরা কোটিপতি!

সায়লা জামান,ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশে অনেকে একযুক পেরিয়ে গেলেও বদলি পাচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ বদলি হলেও শুধুমাত্র তদ্বিরের জোরে ময়মনসিংহের রেঞ্জে কোনো না কোনো থানায় পোস্টিং নিয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় ঘুরেফিরে ময়মনসিংহের রেঞ্জের ভিতরেই রয়ে গেছেন বেশ কয়েকটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। এ নিয়ে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে।

ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার সাবেক ওসি মোঃ মাহমুদুল ইসলাম ২০২৩ সালে চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানাগেছে। ছাত্রজীবনে সরকারী আশেক মাহমুদ কলেজ জামালপুরের ছাত্রদলের জিএস ছিলেন। এমন একজন কর্মকর্তাকে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানা,ভালুকা মডেল থানা ও ত্রিশাল থানায় চাকুরীর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।তিনি দ্বীর্ঘদিন ময়মনসিংহ জেলায় কর্মরত থেকে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। তার নিজ জেলা জামালপুর। এই তিন থানায় চাকুরী শেষে হঠাৎ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এবার আলোচনায় সাবেক ওসি মাহমুদুল ইসলাম পিপিএম।

সবশেষে ময়মনসিংহ জেলা থেকে তিনি অবসর নেন ওসি মাহমুদুল ইসলাম। তিনি চলে গেলেও তার শিষ্যরা এখন ময়মনসিংহ বিভাগের বিভিন্ন থানায় ওসি হিসাবে কর্মরত। তার মত তার শিষ্যরাও আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। ময়মনসিংহ নগরীর সানকি পাড়ায় বিভিন্ন স্থানে জমি ক্রয় করে আলিশান বাড়ি নির্মান করেছেন। সাবেক ওসি মাহমুদুল ইসলামের শিষ্য পুলিশ পরিদর্শক মুশফিকুর রহমান । তিনি এসআই,পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) ওসি নকলা, শেরপুরের ওসি ডিবি, তারপর জামালপুরে, ঘুরেফিরে গুরুত্বপূর্ণ থানায় পোস্টিং পেয়েছেন। ২০০৫ সালে পুলিশে যোগদান করেছেন। তার নিজ জেলা নেত্রকোনার মদন উপজেলায়। অভিযোগ আছে ময়মনসিংহ নগরীতে প্রায় ৫ কোটি টাকার জমি স্ত্রীর ও আত্মীয়-স্বজনের নামে কিনেছেন। নির্মাণ করেছেন কোটি টাকার আলিশান বাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে ময়মনসিংহে রেঞ্জেই চাকরি। এ রেঞ্জ থেকে যেতে চান না তিনি।

স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার তদ্বিরে দুই বছরের ব্যবধানেই কয়েকবার বদলি রেকর্ড করেছেন আরও কয়েকজন আলোচিত ওসি। অভিযোগ আছে, ময়মনসিংহ জেলায় ৬ বছর চাকরি করে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ও নিজ জেলায় প্রায় ২১ কোটি টাকার জমি কিনেছেন । অধিকাংশ জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুশুর বাড়ি ও আত্মীয়-স্বজনের নামে । তার যেখানেই পোস্টিং হয় তার পছন্দের এসআইগনকে সাথে নিয়ে যান। এমন একটি অভিযোগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারসহ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবরে একজন আইনজীবী দায়ের করেছেন। যা অনুসন্ধান করছেন দুদক।

দুদকে দায়ের করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আরেক আলোচিত সাবেক ডিবির ওসি ময়মনসিংহ নগরীর বাইপাস এলাকায় ৭৮ শতাংশ, নটরডেম কলেজ সংলগ্ন ৪৫ শতাংশ, বাইপাস মহাসড়ক সংলগ্ন জামালপুর রোড ৩৪ শতাংশ, শম্ভগঞ্জ এলাকায় ১৩৫ শতাংশ, নেত্রকোনা রোড ২৩ শতাংশ জমি বিভিন্ন সময়ে ক্রয় করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। নগরীর গোয়াইকান্দি এলাকায় ১২ শতাংশ জমির মধ্যে ৬ তলা আলিশান ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি । সেই বাড়িতে তার শ্যালক, ভাই, বোন ও বোন জামাই থাকেন। তাদের নামে দলিল করে দিয়েছেন।

অপরদিকে ময়মনসিংহ জেলার আরেক ওসি নগরীর কাশর জেল রোড ৯ শতাংশ, কাঠগোলা ৪৩ শতাংশ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সংলগ্ন ৫৫ শতাংশ, চরপাড়া কপিক্ষেত এলাকায় ৮ শতাংশ জমি কিনেছেন। যার মূল্যবান ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পারিবারিক বিরোধে সব ঘটনা এবার ফাঁস হয়ে যায়। এই জমি ক্রয় করার সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের এক শীর্ষ মাদক কারবারি তাকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন বলে জানান ওসির শ্যালক । তিনি বলেন, আমার বোন জামাই শুধু নয় ময়মনসিংহের আরও কয়েকজন ওসি মাদক ব্যবসায়ীর সাথে যৌথভাবে জমিও কিনেছেন। তাদের খোঁজখবর কেউ রাখে না। সবাই তেলের মাথায় তেল দেয়।

আরও জানাগেছে, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলায় কর্মরত ১২ জন ওসি এবং ৫ জন টিআই ময়মনসিংহ নগরীসহ নিজ নিজ জেলায় এবং শ্বশুর বাড়িতে শত কোটি টাকার জমি, খামার, ফিসারী, ফলের বাগান, বাংলা বাড়ি, গরুর ফার্ম, ফুলবাড়িয়া ও সখিপুর এলাকায় লেবু বাগান, একাধিক বাস,প্রাইভেটকার কিনেছেন। নামে- বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা রেখেছেন। অনেকের জমি দেখাশোনা করেন পুলিশের সোর্স। এক আইনজীবীর অভিযোগের একটি ফটো কপি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। অভিযোগের সত্যতা জানতে প্রতিবেদক গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা যায়নি। অনুসন্ধান শেষ হলে ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সূত্র আরো জানায়, ইতিমধ্যে সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতি ও অপকর্ম প্রকাশ হওয়ার পর আতঙ্কে রয়েছেন ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের ৫ জন আলোচিত ওসি । সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের আস্থাভাজন ছিলেন তারা । তাদের কথায় ময়মনসিংহ রেঞ্জে কোন থানায়, কাকে ওসি হিসাবে সিলেকশনও করা হবে এমন কথাও প্রকাশ হয় । এই পাঁচজন ওসি দিনরাত আতঙ্কে সময় পার করছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়। দুদকের অভিযোগে আইনজীবি উল্লেখ করেন,ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের এক কর্মকর্তার সাথে ছিল সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের গভীর সম্পর্ক। ওসি বদলিতে ঘুষ লেনদেন করতেন তিনি নিজেই। স্থানীয় এক নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বছরের পর বছর চলে গেলেও তাদের বদলি নেই। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ জেলায় কর্মরত কয়েকজন বিএনপিপন্থী ওসি আওয়ামী লীগ নেতা ও এক এমপির সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে সুবিধামতো থানা পেতে নানা ‘মানবিক’ কারণ সামনে আনছেন। করাচ্ছেন উপর মহলের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে তদবিরও। তবে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, যোগ্যতার ভিত্তিতেই ওসি পোস্টিং হয়। কোন অন্যায় তদবির গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেকেই নিজের সন্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবারের সদস্যদের কারও কারও অসুস্থতার চিত্র তুলে ধরছেন বলে জানান তিনি।

একজন ওসি (ছদ্মনাম আলী ) জানান, আমার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে ময়মনসিংহ শহরে জমি কিনেছি। পুলিশের চাকুরি করে কোন দুর্নীতি করেনি। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় ১৬ বছর চাকরি করে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মালিক হলেন কিভাবে? এমন প্রশ্নের উওরে ওসি বলেন, দেখেন ময়মনসিংহের কয়েক এমপি আমার বাল্য বন্ধু। বেশিরভাগ ছাত্র নেতা আমার বন্ধু। ময়মনসিংহের কয়েকজন বড় সাংবাদিক আমার কাছে নিয়মিত আছে। তাদের ফেসবুক দেখেন আমাকে নিয়ে খুব সুন্দর সুন্দর লেখা দেয়। এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। প্রতিবেদককে বলেন আপনার বস রফিককে বলবেন ভাল হয়ে যেতে। শুধু আমাদের দেখেন কেন? আমাদের চেয়ে একজন এসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তার সম্পদ ৫০ গুন বেশি। তাদের বিরুদ্ধে তো লিখতে দেখি না? আপনি লিখবেন এক পত্রিকায়, আমি পক্ষে করাবো আরও ২০ পত্রিকায়। ঠিক ২৫ মিনিট পরেই এক ময়মনসিংহের এক দালাল নামধারী সাংবাদিক নিউজ না করতে অনুরোধ করেন। বলেন রাতে বসবো,চা খেতে প্রস্তাব দেন প্রতিবেদককে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, স্বামী পুলিশ কর্মকর্তার ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ মাধ্যমে এসব সম্পদের মালিক হন স্ত্রী ও শুশুরবাড়ির আত্বস্বজনরা । তারা স্ত্রীদের নামে সম্পদ করতে নিরাপদ মনে করেন। যেমনটা হয়েছে সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের বেলায়। দুদক কর্মকর্তরা বলেন, প্রতিটি স্ত্রীরই জানা উচিৎ স্বামীর এ সম্পদগুলো বৈধ না অবৈধ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ সব মামলায় স্ত্রী স্বামীরা হলেন, পুলিশ কর্মকর্তা স্ত্রীর নামে বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা রাখেন অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীরা। আর এসব সম্পদই এক সময় কাল হয়ে যায়। স্বামীর অর্জিত অবৈধ সম্পদের অংশীদার হয়ে তারাও মামলায় আসামি হচ্ছেন এবং জেল জরিমানার সন্মুখীন হচ্ছেন।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |