রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

ছাগল এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি”

ছাগল এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি”

ছাগল এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি”

রেজাউল করিম রেজা:
কুরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় কেনা একটি ছাগল এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। ক্রেতার পরিচয় ঘিরে চলছে তোলপাড়। ছাগলটির গলা জড়িয়ে ধরা তরুণের ভিডিও ও স্থিরচিত্র রীতিমতো ভাইরাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তরুণের বাবা হিসাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য ড. মো. মতিউর রহমানের নাম মূলধারার কয়েকটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পেলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় বুধবার দৃশ্যপটে এসে মুখ খুলেন মতিউর। দাবি করেন, ছাগলের সঙ্গে ভাইরাল হওয়া তরুণ তার ছেলে নয়। তরুণের সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্কও নেই। এরপরই প্রশ্ন ওঠে-তাহলে কি নিজের অবৈধ সম্পদ আড়াল করতে ছেলেকেই ‘কুরবানি’ করছেন বাবা?

বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের ঔরসে দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর গর্ভে জন্ম ভাইরাল হওয়া তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাত। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে ২০২৩ সালে এসএসসি পাশ করা ইফাত এখন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী। এই ঘরে আরও দুই সন্তান আছে। মেয়ের নাম ইফতিমা রহমান মাধবী। তিনি বারডেম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রী। আর ছেলে ইরফান ৭ বছরের শিশু। প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষক। বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তার গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব।

আমেরিকা থেকে শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন তিনি। আর মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতার বিলাসী জীবনের খোঁজ মিলেছে কানাডায়। শেয়ারবাজারে ‘গ্যাম্বলার’ হিসাবে পরিচিত মতিউরের রয়েছে বিপুল বিনিয়োগ। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বহুতল বাড়ি, টঙ্গীতে গার্মেন্ট সরঞ্জাম তৈরির বিশাল কারখানা, ভালুকা ও বরিশালে পাদুকা ফ্যাক্টরি, নরসিংদী ও পূর্বাচলে ইকোপার্ক, রিসোর্টসহ নামে-বেনামে রয়েছে সম্পদের পাহাড়। আপাদমস্তক অসৎ এই কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন চার দফা টিম গঠন করলেও রহস্যজনক কারণে প্রতিবারই অভিযোগ পরিসমাপ্তির নামে তাকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

জানা গেছে, ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্রী থাকা অবস্থায় বিবাহিত মতিউরের নজর কাড়েন শাম্মী আখতার শিভলী। এরপর তাকে বিয়ে করে সংসার সাজান লালমাটিয়ার নিজস্ব ফ্ল্যাটে। সেখানেই জন্ম হয় বড় মেয়ে ইফতিমা রহমান মাধবীর। জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বাবার নাম মো. মতিউর রহমান। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শুরুর দিকে লালমাটিয়ার একই ফ্ল্যাটে ছিল দুই স্ত্রীর বসবাস। কিন্তু তা সুখের হয়নি। দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছালে লালমাটিয়া থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী চলে আসেন অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে। ৮ নম্বর রোডের ৪১/২ নম্বরে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল সুলতানা ভবনের পাঁচতলায় আবাস গড়েন।
পাঁচতলার পুরো ফ্লোর শাম্মী আখতারের নামে কিনে সাজানো হয় নজরকাড়া ইন্টেরিয়রে। প্রায় দুই কোটি টাকার সাজসজ্জার কাজের মধ্যে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয় শুধু রান্নাঘরের সৌন্দর্যবর্ধনে। ইফাতের মামা নোকিবের তত্ত্বাবধানে ২ বছর আগে এসব কাজ করা হয়। এ বাড়িতে থাকতেই জন্ম হয় ইফাত ও ইরফানের।
শাম্মীর গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীর সোনাপুর গ্রামে। বাবার নাম মঈনদ্দিন হাওলাদার। ছবি ও বুবলি নামে দুই বোন রয়েছে শিভলীর। তার আরেকটি পরিচয় রয়েছে। তিনি ফেনী-২ আসনের সংসদ-সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর মামাতো বোন। মতিউর দ্বিতীয় স্ত্রী-সন্তানের পরিচয় অস্বীকার করলেও বোন-ভাগনের কথা স্বীকার করেছেন নিজাম হাজারী। বলেছেন, ‘ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই তার বাবা। এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে ইফাত। রাগ-অভিমান থেকে তিনি হয়তো ইফাতের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেছেন।’

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে ইফাতের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। পাঁচতলায় ঢোকারও অনুমতি পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তাকর্মী মোক্তার হোসেন ইন্টারকমে এ প্রতিবেদকের পরিচয় জানালে অ্যাপার্টমেন্ট মালিক সমিতির সভাপতি ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি। তিনি জানান, ২ দিন আগে পরিবারের সবাই একযোগে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তবে এবারও ইফাত দুটি গরু ও তিনটি খাসি কুরবানি করেছেন বলে জানান নিরাপত্তাকর্মী। প্রতি বৃহস্পতিবার এ বাসায় যেতেন মতিউর রহমান। তবে সেখানে রাত্রিযাপন করতেন খুব কম। মধ্যরাতের পর বেরিয়ে বসুন্ধরার বাড়িতে চলে যেতেন। সেখানে বসবাস করেন প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী।

বৃহস্পতিবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৭/এ নম্বর রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে গিয়েও মতিউর রহমান বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ কাঠা আয়তনের প্লটে তৈরি করা সাততলা ভবনের এক ফ্লোরে বসবাস করেন মতিউর ও তার প্রথম স্ত্রী। এই বাড়িতে মতিউর, তার স্ত্রী ও ছেলের ব্যবহারের জন্য ৫টি গাড়ি রাখা আছে।

জানা গেছে, ছেলে হিসাবে অস্বীকার করার পরই ধানমন্ডির বাসা ছেড়ে কাকরাইলের নিজস্ব ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠেন ইফাত, তার মা ও ছোট ভাই। বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত তারা ওই বাসাতেই ছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে ৪৮.৪৯ কাকরাইলে অবস্থিত স্কাই ভিউ মমতা সেন্টার নামের ওই আবাসিক ভবনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবনের ৭/ডি নম্বর ফ্ল্যাটটিও তাদের কেনা। ফ্ল্যাটের নিরাপত্তাকর্মী রবিউল ইসলাম জানান, এই ফ্ল্যাটে ইফাত, তার মা ও ছোট ভাই মাঝেমধ্যে থাকতেন। সেখানে যেতেন মতিউর রহমান। এসব বিষয়ে জানতে মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।

 

এদিকে ইফাতের চালানো একাধিক গাড়ির নম্বর ধরে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) অনুসন্ধান চালিয়েও পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইফাত পার্ল কালারের প্রাডো মডেলের বিলাসবহুল যে গাড়িটি (নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ ১৫-৯৩২৭) হাঁকিয়ে বেড়ান, সেটার মালিকানা এসকে ট্রিম অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে। এটি গার্মেন্ট সরঞ্জাম তৈরি ও সরবরাহের বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীতে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর ডিরেক্টর হিসাবে মতিউর রহমানের ভাই এমএ কাইয়ুম হাওলাদারের নাম পাওয়া গেছে।
প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ শেয়ারের মালিক তিনি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও তিনি। আবার প্রাডো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নথিতে এসকে ট্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে নিকেতনের ই-ব্লক, ৮ নম্বর রোডের ৩৪ ও ৩৬ নম্বর প্লটে অবস্থিত মুন আইল্যান্ড নামক ভবনের স্যুট নম্বর ৮। ইফাত ও তার মা শাম্মী আখতার প্রিমিও মডেলের (ঢাকা মেট্রো গ ৩২-৬২৩৯) যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, সেটির মালিকানা গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামে।

 

নিকেতনের একই ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেখানে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া গেছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ঈদের ছুটির কারণে অফিস বন্ধ। তবে প্রতিষ্ঠানের সামনে সাইনবোর্ডে চোখ আটকে যায় এ প্রতিবেদকের। সেখানে লেখা ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট। সাইট অফিসের ঠিকানা-মারজাল, রায়পুরা, নরসিংদী। এ রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের মানিক এবং পরিচালক মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রীর ছেলে তৌফিকুর রহমান ও মেয়ে ফারজানা রহমান।

 

পারিবারিক সূত্র জানায়, মতিউর রহমানের জীবনাচরণ রহস্যে ঘেরা। দুই হাতে টাকা ওড়ান তিনি। বসুন্ধরার বাসা থেকে জাতীয় রাজস্ব ভবনের অফিসে যেতে কখনো সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন না। বাসা থেকে অফিসে যেতে তিনবার গাড়ি পরিবর্তন করেন। সবশেষ কাকরাইল এলাকায় নেমে সরকারি গাড়িতে উঠে অফিসে যান।

তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের গাড়ি চালানোর জন্য বর্তমানে ৫ জন ব্যক্তিগত চালক আছেন। প্রাডো, বিএমডব্লিউ, রেঞ্জরোভারসহ বিলাসবহুল আট থেকে ১০টি গাড়ি আছে তাদের। তবে প্রায় সব গাড়ির মালিকানা তাদের বিভিন্ন কোম্পানির নামে। দেশের একটি খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চুক্তিপত্র দলিলের মাধ্যমে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে মতিউরের। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ওই প্রতিষ্ঠানের করপোরেট অফিস। প্রতিষ্ঠানটি একসময় মতিউরের প্রতিষ্ঠা করা ভালুকার গ্লোবাল সুজ কারখানা ভাড়া নিয়ে চালিয়েছিল। বৃহস্পতিবার স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ভালুকার ওই কারখানা সরেজমিন বন্ধ পাওয়া গেছে। প্রায় ৩০০ বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠা করা ওই কারখানার নামে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগও আছে। এসকে ট্রিম ইন্ডাস্ট্রির নামে রেজিস্ট্রেশন করা প্রাডো গাড়ি ইফাত কীভাবে চালান, এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমানের ভাই এমএ কাইয়ুম হাওলাদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |