রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪০ পূর্বাহ্ন
খায়রুল আলম রফিক: সরকারি কর্মচারীদের আলীশান ভবন আর অভিজাত ফ্ল্যাট-এপার্টমেন্ট মিলিয়ে যেন আরেক বেগমপাড়ায় পরিনত হয়েছে ময়মনসিংহ নগরী। বিভাগের সরকারি দপ্তরের কেরানি, ক্যাশিয়ার, হাসপাতালের উচ্চমান সহকারী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এমনকি এমএলএসএস-পিওনরা পর্যন্ত আট তলা থেকে ১৬ তলা উচ্চতার বিশাল বিশাল ভবন গড়ে তুলেছেন। একাধিক কর্মচারী যৌথ মালিকানাতেও বানিয়েছেন দৃষ্টিনন্দন বহুতল এপার্টমেন্ট। ময়মনসিংহ নগরীর আমলাপাড়া ও গোলকিবাড়ি আশপাশ মহল্লাতেই সরকারি কর্মচারীদের অন্তত ৩৫টি আলীশান ভবন গড়ে ওঠার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব আলীশান ভবন ছাড়াও বিভাগের বিভিন্ন স্থানে তারা প্রায় সাড়ে পাঁচ‘শ একর জায়গা-জমিও কিনেছেন। তাদের বেগমদের নামেই দেওয়া রয়েছে সিংহভাগ সহায় সম্পদের মালিকানা।
নিকটাত্মীয়সহ নামে বেনামে করা হয়েছে বাকি সম্পদ। ময়মনসিংহে আরেক ‘বেগম পাড়া’ নাম দিয়েছে কর্মচারীরাই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৪৩ জন কর্মচারীর মধ্যে ৬৭ জনই আলাদীনের চেরাগ স্টাইলে কোটিপতি হয়েছেন। কারো কারো অর্থ-সম্পদের পরিমাণ শত কোটির ঘরও পেরিয়ে গেছে। দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর ও জেলা সদরে বছরের পর বছর কর্মরত এসব কর্মচারী কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সেসব বিষয়ে ময়মনসিংহ দুদকের নামমাত্র তদন্ত হলেও দীর্ঘসময় ধরে ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের মধ্যে হাতে গোণা কয়েকজনের বিরুদ্ধে দায়সারা গোছের মামলা হলেও বেশিরভাগ রাঘববোয়ালই রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা সব মহলকে ম্যানেজ করে দিন দিনই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন। এসব লুটেরা, দুর্নীতিবাজ কর্মচারী আগে চুপিসারে অর্থবিত্ত গড়ে তুললেও এখন আর কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করছেন না বরং তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত বিত্ত বৈভবের শান-শওকত তারা অহঙ্কারের সাথেই প্রকাশ করছেন, সহায়-সম্পদও গড়ছেন অর্থ বাহাদুরীর পাল্লাপাল্লিতে। আভিজাত্যে মোড়া দৃষ্টিনন্দন ১১ তলা স্বপ্ন টাওয়ার নামে পরিচিতি আলীশান ভবন নির্মাণ করে সবচেয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ক্যাশিয়ার মোঃ এনামুল হক, ভুমি কর্মকর্তা আব্দুল গনি,পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম এবং কয়েকজন যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সহ ১৮ জন। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন স্থানে ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক ফারজানা পারভিন, সাবেক সহকারি পরিচালক নুরুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক সহকারি পরিচালক মো: জোয়াহের আলী মিয়া,গৌরীপুর উপজেলা যুব উন্নয়নের সাবেক কর্মকর্তা নদ্দন কুমার দেবনাথ,ত্রিশাল উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপজেলা কর্মকর্তা মো: আবু জুলহাস,ফুলবাড়ীয়া উপজেলার সাবেক যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ,ভালুকার গোলাম মোস্তফাসহ প্রায় ৬৭ জন কর্মচারী অবৈধ টাকায় আলিশান বাড়ি নির্মান করে বসবাস করছেন।
এরই মধ্যে আরেক ঘটনায় আলোচনায় আসেন ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আলমগীর হোসেন। তিনি নিয়োগ বানিজ্য, জালিয়াতি ও স্টাফ কোয়ার্টার বরাদ্দে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি ও দুর্নীতির সাথে সরাসরি জড়িত বলে দুটি অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। দুদক সূত্রে জানাগেছে, ময়মনসিংহের ডিবির সাবেক এসআই আকরাম হোসেন ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন মেইনের গেইটের বিপরীতে ৬ তলা আলিশান বিলাসবহুল একটি বাড়ি নির্মান করেন ও মুক্তাগায় শুশুরবাড়ি এলাকায় প্রায় ১২ একক কৃষি জমি ক্রয় করেছেন। যার পরিমান অনুমান প্রায় ১২ কোটি টাকা। এই অবৈধ সম্পদের মালিক আকরাম হোসেন ও তার স্ত্রী ও ভাই-বোনেরা।এমন একটি অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। এছাড়াও ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জেলার বর্তমানে জেল সুপার চলতি দায়িত্বে আব্দুল্লাহ ইবনে তোফাজ্জল হোসেন খান।
তিনি ময়মনসিংহ নগরীর জামতলা মোড়ে ৬ শতাংশ জমির উপর ৭ তলা একটি আলিশান ভবন নির্মান করছেন। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ৫ স্থানে জমি ক্রয় করেছেন। যার মুল্য অনুমান ৪ কোটি টাকা। কয়েকজনের নামে ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মোকদ্দমা নং- ০১/২০২৩ ইং একটি মামলা করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ময়মনসিংহ জেলা শাখার উপসহকারী আনিসুর রহমান ও শাহজাহানকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। মামলার আবেদনে ধারা উল্লেখ করা হয়েছে দন্ডবিধি ৪০৯ ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)। এর মধ্যে কয়েকজন বিশ্বস্থ সহযোগিদের নিয়ে নগরীর গোলকিবাড়ি এলাকায় যৌথভাবে নির্মাণ করেছেন ১১ তলা বিলাসবহুল বাড়ি।
আধুনিক নকশা ও কারুকার্য খচিত বহুতল ভবনটি দেখার জন্য শহরের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনও ভিড় করেন সেখানে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্যাশিয়ার মোঃ এনামুল হক ও তার ঘনিষ্ঠ ১৮ জন (কর্মচারী/কর্মকর্তা) মিলে ১১ তলার আলীশান ভবন নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। ময়মনসিংহ অঞ্চলের নদী খননের নামে সাগর চুরি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকায় শিরোনাম হওয়ার পর কোটিপতিতে পরিনত হয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়াও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৪ জন উচ্চমান সহকারী, হিসাবরক্ষক, সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ৯ জন এমনকি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মচারীও রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ময়মনসিংহের সড়ক ও জনপথ বিভাগের সার্ভেয়ারসহ পাঁচ কর্মকর্তার কাছেই শত কোটি টাকার সন্ধান মিলেছে। তারা নগরীর বিভিন্ন মহল্লা ছাড়াও খোদ রাজধানীতেও কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন।
একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন, পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করছেন দামি দামি গাড়ি। তিন কর্মকর্তার ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করেন ইউরোপ-আমেরিকায়, তাদের সেকেন্ড হোম গড়েছেন কানাডায়- এসব খবর ঘুরে বেড়ায় সওজ কর্মচারীদের মুখে মুখে। উচ্চমান সহকারী পদবির একজন সাদেকুল ইসলামের সম্পত্তির বিবরণ উদঘাটন করে প্রতিদিনের কাগজ অনুসন্ধান টিমের সদস্যরাও অবাক হয়েছেন। ময়মনসিংহে চাকরিরত অবস্থায় একজন সরকারি কর্মচারী কিভাবে এতসব সম্পদের মালিক হয়েছেন- তার তত্বাবধায়নকারী কর্তাদের যেন তা নজরেও পড়েনি। প্রাথমিক ভাবে খোঁজ নিয়েই জানা গেল, উচ্চমান সহকারী সাদেকুল ইসলাম নগরীর আমলাপাড়া ও গোলকিবাড়ী এলাকায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ১১ তলা ভবন ও ৪৫ শতাংশ জমি কিনেছেন। জমি ক্রয়ের দলিল নাম্বারগুলো হচ্ছে- ১২০, ২৩০৭, ৫৬৯, ৭০৪, ৭০০ ও ৫৪৫। তার দ্বিতীয় স্ত্রী আইরিন আক্তারের জন্য রাজধানীর উত্তরায় ১০ নাম্বার সেক্টরে ৫ শতক জায়গার উপর ৯ তলা বিলাসবহুল বাড়ি কওে দিয়েছেন। তিনি উত্তরা, ধানমন্ডি, ময়মনসিংহের আমলাপাড়া, গোলকিবাড়িতে আরো ৭টি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন। যার আনুমানিক খরচ ৫ কোটি টাকা। সাদেকুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী সোনিয়া আক্তার প্রতিবেদককে জানান,আমার স্বামী দুর্নীতি করে অবৈধভাবে এই টাকা অর্জন করেছেন। বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করায় (সাদেকুল ইসলাম) দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
দুদক এক কর্মকর্তা জানান, ক্যাশিয়ার এনামুল হকের সম্পদের খোঁজ করতে গিয়েই ময়মনসিংহের ৬৭ জনের বিপুল সম্পদ থাকার বিষয়টি বেরিয়ে প্রকাশ্যে আসে এবং দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা তাদের স্ত্রী/বেগমদের নামে ৩৫টি আলিশান বিলাসবহুল বাড়ি নির্মান করেছেন। এবিষয়ে দুদক আরও খোঁজখবর নিচ্ছেন বলেও জানান তিনি । দুদকের কর্মকর্তা আরও বলেন, অনুসন্ধানে বিপুল সম্পদ থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর ময়মনসিংহ নগরীতে শতাধিক ফ্ল্যাট থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয় দুদক। এর বাইরে কয়েক কর্মচারীর ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের ক্যাশিয়ার এনামুল হক জানান, আমরা ১৮ জন মিলেমিশে ২০১১ সালে ৬ শতাংশ জমি ক্রয় করি। পরে ধীরে ধীরে ১১ তলা নির্মান করেছি। ভুমি কর্মকর্তা (নায়েব) আব্দুল গনি ও কয়েকজন যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাসহ ১৮ জন মিলেমিশে নির্মান করা হয়েছে। এখনও কাজ চলমান আছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ পথে সম্পদ গড়েছেন এমন কর্মচারীদের তালিকা করা হচ্ছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকতার বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের একাংশ স্বীকার করলেও, তাদের অনেকেই এই দুর্নীতির দায় ঢালাওভাবে শুধু সরকারি কর্মচারীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের এই দুর্নীতি অনেক ক্ষেত্রেই যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও যোগসাজশ ছাড়া সম্ভব নয়, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ঘাটতির অন্যতম কারণ যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, তার দায়ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। মূলত বারবার সরকারের শীর্ষ অবস্থান থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতির কথা বলা হলেও, তা যে শুধুফাঁকা বুলি-জনমনে গেঁথে যাওয়া এমন ধারণা থেকে উত্তরণের দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই নিতে হবে। আপনার কাছে শুনে হতভাগ হলাম। সামান্য কেরানীরা এত টাকার মালিক কেমনে হলেন।
ময়মনসিংহের গণপূর্ত, কৃষি সেক্টর, বন বিভাগ,সরকারী হাসপাতাল,স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ভুমি কর্মকর্তাসহ আরো কয়েকটি বিভাগের চালচিত্র নিয়ে প্রতিদিনের কাগজ এর অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। শিগগিরই সেসব ক্ষেত্রের কোটিপতি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিবরণ তুলে ধরতে প্রতিদিনের কাগজ অঙ্গীকারাবদ্ধ। চোখ রাখুন আগামী পুর্বে ।