শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৫ অপরাহ্ন

আপডেট
অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী পুলিশ কর্মকর্তারা চিহ্নিত

অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী পুলিশ কর্মকর্তারা চিহ্নিত

অতিরিক্ত বল প্রয়োগকারী পুলিশ কর্মকর্তারা চিহ্নিত

আতিকা ইসলাম,ঢাকা : বছরের পর বছর তারা পুলিশকে দিয়ে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করিয়েছেন। যাকে খুশি তাকে ধরে এনে মামলা দিয়েছেন। এভাবেই সদ্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের তারা আস্থাভাজন এই পুলিশ কর্মকর্ততারা । বিনিময়ে তারা বাগিয়ে নিয়েছেন ভালো ভালো পোষ্টিং। ঘটেছে পদোন্নতি। এর সাথে দুর্নীতি করে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। অনেকে এই টাকা বিদেশেও পাঠিয়েছেন। সেখানে গগেছেন আলিশান বাড়ি। আর সব কিছুর ফলে নষ্ট করেছেন পুলিশ বিভাগকে। জনগণের আস্থা হারিয়ে ‘বন্ধু পুলিশ’ থেকে মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘শত্রু পুলিশ’ হিসেবে। এই পুলিশ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের রাখা হয়েছে নজরধারীতে। কেউ যেন পালাতে না পারে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা একই বিভাগে দ্বীর্ঘদিন । কেউ কেউ এসপি ,এডিশনাল ডিআইজি পরে ডিআইজি হয়েই একই বিভাগে রয়েছেন।

 

পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেন, ‘পুলিশের পেশাদারিত্ব ধ্বংসের জন্য বিশেষ একটি এলাকা ও রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তারাই দায়ী। এরা পুলিশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোতে বসে পুলিশকে রাজনৈতিক দমন নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পিআরবিসহ প্রচলিত যাবতীয় বিধি লঙ্ঘন করেছেন এবং তারা সরাসরি আওয়ামী লীগের লোক হয়ে কাজ করেছেন। সম্প্রতি উচ্চাভিলাষী ও অপেশাদার পুলিশ সদস্যদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এই তালিকায় অর্ধশতাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তালিকা তৈরির কাজ এখনো চলছে। এখনো সেটা চূড়ান্ত করা হয়নি। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

 

তিনি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তাকে দেখা গেছে সরাসরি হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য শুনছেন। কিন্তু গুলি করে মানুষ হত্যার কোনো প্রতিবাদ করছেন না। তালিকায় রয়েছেন, অতিরিক্ত আইজি কামরুল আহসান, আতিকুল ইসলাম ও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নাম রয়েছে। এসবির সদ্য ওএসডি হওয়া এসবি প্রধান মো, মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজি ওয়াইএম বেলালুর রহমান, শিল্প পুলিশের প্রধান মাহবুবুর রহমান, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদ্য ওএসডি হওয়া অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, চট্টগাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম। ডিএমপির ওএসডি হওয়া কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি অপারেশন আনোয়ার হোসেন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার, ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আবদুল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম।

 

গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার মো: মাহবুব আলম, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো: মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দফতরের জয়দেব কুমার ভদ্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মো: আসাদুজ্জামান। শাহ মিজান শফিউর রহমান, মো: আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, এস এম মোস্তাক আহমেদ, জিহাদুল কবীর, মো: ইলিয়াস শরীফ, নূরে আলম মিনা, ময়মনসিংহের ডিআইজি শাহ আবিদ হোসেন, মো: জামিল হাসান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বহুল আলোচিত মো: হারুন অর রশীদ, এসবির মোহা. মনিরুজ্জামান, শ্যামল কুমার নাথ, মো: সাইফুল ইসলাম, মো: আলমগীর কবির, মো: হামিদুল আলম, ড. শামসুন্নাহার, শেখ রফিকুল ইসলাম, ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন ও মো: মাসরুকুর রহমান খালেদ। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মো: মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক ও সুব্রত কুমার হালদার, শ্যামল কুমার মুখার্জী, মো: সাজ্জাদুর রহমান, প্রবীর কুমার রায়, আ স ম মাহতাব উদ্দিন, মোহা আহমারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মো: মোকতার হোসেন ও পঙ্কজ চন্দ্র রায়। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এস এম মেহেদী হাসান, একই ব্যাচের মোহাম্মদ জায়েদুল ইসলাম ও সঞ্জিত কুমার রায়। ২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৪ ব্যাচের মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, ডিবি উপকমিশনার মশিউর রহমান (সদ্য সিএমপিতে বদলী), নাবিদ কামাল শৈবাল, মো: শহিদুল্লাহ, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ।

 

২০০৬ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৫ ব্যাচের ঢাকার এসপি মো: আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, পাবনার এসপি মো: আব্দুল আহাদ, ডিএমপির মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, রাজিব আল মাসুদ ও মো: শাহ জাহানসহ আরও ৪০ জেলার এসপি রয়েছেন। এ ছাড়া, মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান, সরকার মোহাম্মদ কায়সার, মোহাম্মদ মইনুল হাসান, মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, আসমা সিদ্দীকা মিলি, কাজী আশরাফুল আজিম, হায়াতুল ইসলাম খান এবং জসিম উদ্দিন মোল্লারও নাম উঠে এসেছে অতি বলপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের তালিকায়। এরমধ্যে সাংবাদিক নির্যাতন করে আলোচিত হয়েছেন কক্সবাজার সাবেক পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন ও ময়মনসিংহের সাবেক এসপি শাহ আবিদ হোসেন। এসপি আবিদ হোসেন ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক এসআই আকরাম হোসেনকে নির্দেশ দেন দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক মো: খায়রুল আলম রফিককে ধরে আনতে।

 

২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মচিমহার সামনে থেকে আটক করেন। দেওয়া হয় আইসিটি মামলা। ময়মনসিংহের ডিবির আয়না ঘরে দফায় দফায় চালানো হয় নির্যাতন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রমোশন নিয়ে এডিশনাল ডিআইজি হন শাহ আবিদ হোসেন। তিনি এসপি থেকে একই বিভাগে ডিআইজি হিসাবে কর্মরত। এই দুই সাবেক পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে মানবাধিকারকর্মী আলন পোদ্দার বাদী হয়ে বর্তমান সরকারের মাননীয় উপদেষ্টার নিকট তাদের বিচার চেয়ে আবেদন করেন এবং এই দুই সাংবাদিকের উন্নত চিকিৎসার জন্য সহায়তা চেয়েছেন। পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন কক্সবাজার জেলায় কর্মরত থাকাকালে ২০১৯ সালে দৈনিক কক্সবাজারবানী পত্রিকার সম্পাদক ফরিদুল মোস্তাফাকে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের মাধ্যমে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়েছিলেন। সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা খান জানান, তৎকালীন টেকনাফ থাকার ওসি প্রদীপের নামে নিউজ করেছিলাম। শিরোনাম ছিল‘টাকা না দিলে ক্রসফায়ার দেন টেকনাফ থানার ওসি’এমন সংবাদ প্রকাশের পর আমাকে গুম করে রাখেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। আমাকে গ্রেফতারের পর কয়েক দিন আটক রেখে নির্যাতন চালায়। সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তাফা বলেন, সংবাদ প্রকাশের পর সাবেক ওসি প্রদীপ আমাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তারপর একটি কক্ষে নিয়ে আমার চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। চোখে মরিচের গুঁড়া দিয়ে দেয়। যে কারণে আমি দৃষ্টি হারাতে বসেছিলাম। সেই নির্মম নির্যাতনের পর আমাকে কক্সবাজার শহরের কবিতা চত্বর এলাকায় নিয়ে ক্রসফায়ার দেওয়ার চেষ্টা করে। তা না করে পরে আমাকে বিদেশি মাদক দিয়ে ছয় মামলায় আসামি করা হয়। আমি এখন অসহায়।

 

সাংবাদিক খায়রুল আলম রফিক বলেন, আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিন পত্রিকায় ডিবির অপকর্ম ও ডিবির আয়না ঘরে বিএনপি-জামাতকর্মীদের নির্যাতন চালানো হয় এমন কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় আমার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর জেরে ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১১টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে নিউ মেডিকেয়ার ডায়াগনস্টিকের সামনে থেকে আমাকে আটক করা হয়। ডিবির এসআই আকরাম হোসেনসহ সাদা পোশাকধারী অজ্ঞাত ৭-৮ জন আমাকে চোখ বেঁধে একটি হায়েজ গাড়িতে তুলে নেন। গাড়িটি পুরাতন গোদারাঘাটের ওপারে চরাঞ্চলে যায়। তখন ডিবির এসআই আকরাম হোসেনের মোবাইল ফোনে অপর প্রান্ত থেকে একজন বলছেন, ‘রফিককে আটকের খবর সাংবাদিকরা জেনে গেছে। তাকে এ মুহূর্তে ক্রসফায়ারে দেয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে আসো।’ ফোন লাউড স্পিকারে ছিল। খায়রুল আলম রফিক বলেন, আমি কোনো অপরাধী না হয়েও ময়মনসিংহের ডিবি’র হাতে আটকের পর তিনদিন অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেছি।

ক্রসফায়ারে ব্যর্থ হয়ে আইসিটি আইনে মামলা দিয়ে আমাকে আদালতে পাঠায়। শুরু হলো আমার কারা জীবনের নতুন অধ্যায়। দুই মাস কারাভোগে আমার জীবনে আঁধার নেমে আসে। নির্যাতনের কারণে আমি আজও চোখে ঝাপসা দেখি, শরীরে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ শকের কারণে রক্তশূন্যতাসহ বিভিন্ন মারাত্মক শরীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে আমার চোখ বাঁধা নির্যাতনের ছবি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে এসআই আকরাম এবং এএসআই জুয়েলসহ অন্যরা। এতে আমি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হই এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। গত ১৮ জানুয়ারি এসআই আকরাম এবং এএসআই জুয়েলসহ ৭-৮ জন ডিবি কর্মকর্তাকে আসামি করে ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করি। তারপর আদালতের নির্দেশে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানায় মামলা আমলে নেন পুলিশ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক ফারুক হোসেন। আসামীরা সকলেই পুলিশ হওয়ায় সাবেক এসপি আবিদ হোসেনের নির্দেশে মিথ্যা বলে চালিয়ে দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আকরাম হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে খায়রুল আলম রফিককে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। তাকে নির্যাতনের অভিযোগ সঠিক নয়। ঘটনার দুই বছর পর তিনি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তদন্তে যদি আমি দোষী হই তবে আমাকে যে শাস্তি দেওয়া হবে তা মেনে নেব।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |