বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক কখনোই একরৈখিক বা সহজসাধ্য ছিল না। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, এবং দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা আস্থার সংকট—এই সবকিছুই দুই দেশের সম্পর্ককে অব্যাহতভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে, সময়ের চাকা ঘুরে চলেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বদলেছে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়েছে, এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে: ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক কি সত্যিই একটি নতুন মোড়ে প্রবেশ করছে, না কি আমরা কেবল পুরনো পাঠই আবার নতুন করে পাঠ করছি?
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সরাসরি পাকিস্তানের সঙ্গে জড়িত। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়টিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্রভাবে প্রকাশ পায়, যার পরিণতিতে আসে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম এক দশকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বলা চলে একদমই বিচ্ছিন্ন থাকে। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহল বহুদিন পর্যন্ত ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিষয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার হলেও পাকিস্তানের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ভালো হয়। তবে ভারতের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল। আবার ২০০৯ সাল পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ হয়। তবে পাকিস্তানের সম্পর্ক চলে একদম তলানীতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সালে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়ার পর পাকিস্তান আপত্তি জানায়। এরপর থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্তের অবনতি হতে থাকে।
সম্প্রতি আগষ্ট পরবর্তী হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়নের পর দুইটি দেশের সম্পর্ক জোড়দারের কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ অন্তবর্তীকালিন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সম্পর্ক জোড়দারের তাগিদ দেন। এছাড়া গতবছরের ১৩ ই নভেম্বর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের করাচি থেকে চট্রগ্রাম সমুদ্রবন্দরে সরাসরি সমুদ্রপথে পণ্যবাহী জাহাজ আসে। যা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে বড় পদক্ষেপ বলে বিবেচনা করা হয়। ২০১০ সালের পর সম্প্রতি ১৭ এপ্রিল
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন উদ্দিনের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে ৭১ এর বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক 'স্বাভাবিকীকরণের' আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে, যাতে গুরুত্ব পাবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও উভয় দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু।
তবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর এক অদৃশ্য ছায়া হিসেবে কাজ করে ভারত। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে—একদিকে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে ধর্মীয় ও কৌশলগত সংযোগ। কিন্তু যখনই ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাড়ে, বাংলাদেশের অবস্থানও চাপে পড়ে যায়।
ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক কিছু দ্বিপক্ষীয় ইস্যু—যেমন তিস্তা পানি চুক্তি, সীমান্ত হত্যা, বা বৈষম্যমূলক বাণিজ্য—বাংলাদেশকে বিকল্প কূটনৈতিক দ্বার খুঁজতে উৎসাহিত করছে। এই সুযোগে পাকিস্তানও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি কৌশলগতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সত্যিকারের সম্পর্ক গড়তে চায়, নাকি এটা কেবল ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নের কৌশল?
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম অনেকাংশেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে পাঠ্যবই আর মিডিয়ার মাধ্যমে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নয়। তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত। অনেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক উপাদান—গান, সিরিজ, ক্রীড়া—নিয়ে আগ্রহী। আবার কেউ কেউ মনে করেন, ৫০ বছর আগের সংঘাত দিয়ে বর্তমান রাজনীতিকে চিরকাল প্রভাবিত করা ঠিক নয়।
তবে তরুণদের এই দৃষ্টিভঙ্গি কি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে? নাকি তরুণদের মনোভাবকে ব্যবহার করে একটি “soft approach”-এর মাধ্যমে পুরনো সংকটকে আড়াল করা হচ্ছে? এ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানকে নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচুর প্রতিবেদন হলেও, সেগুলোর অধিকাংশই অতীতনির্ভর এবং নেতিবাচক। রাজনৈতিক দলগুলোও প্রায়শই পাকিস্তান-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে একে অপরকে দোষারোপ করে। এতে সম্পর্কের বাস্তবতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমেও বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক সময় ভুল তথ্য পরিবেশন হয় বা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ফলে, সম্পর্ক গড়ার পরিবর্তে ভুল বোঝাবুঝির জাল আরও জটিল হয়।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক আজ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে আটকে আছে—একদিকে সৌজন্যপূর্ণ কথাবার্তা, অন্যদিকে অতীতের রক্তাক্ত স্মৃতি; একদিকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, অন্যদিকে বর্তমানের রাজনৈতিক সংশয়।
তবে আমার মতে, নতুন মোড়ের পথে এগোতে হলে, দুই দেশকেই কিছু সাহসী রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অতীতের ভুল স্বীকার, সত্যিকারের দুঃখপ্রকাশ, গণমানুষের অনুভূতির প্রতি সম্মান এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি—এই সবকিছু ছাড়া সম্পর্ক জোড়া লাগবে না।
এছাড়া বাংলাদেশেরও উচিত দেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতির আলোকে সম্পর্ক উন্নয়ন করা।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়: আমরা কি সত্যিই নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, নাকি এই কূটনৈতিক সৌজন্য আসলে পুরনো পাঠেরই পুনরাবৃত্তি?
মো পারভেজ সেখ
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
আপনার মতামত লিখুন :