সাংবাদিকতায় এআই: বিপ্লব নাকি বিপদ?

কে. আই. আল আমিন , বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০১:০৫ পিএম

গ্রাফিক্স- প্রতিদিনের কাগজ

সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও কিংবা অনলাইন প্রতিটি মাধ্যম সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। প্রযুক্তি যেমন সাংবাদিকতার গতি বাড়িয়েছে, তেমনি এর চরিত্রও পাল্টেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাংবাদিকতায় সবচেয়ে আলোচিত প্রযুক্তি হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। কেউ বলছেন, এটি সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ; আবার কেউ আশঙ্কা করছেন, এটি সাংবাদিকতার মূল সত্তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

২০২৩ সালে রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম এর এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৮০% সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যেই কোনো না কোনোভাবে এআই ব্যবহার করছে। ওয়াশিংটন পোস্টের হেলিওগ্রাফ নির্বাচনের ফলাফল ও খেলাধুলার খবর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করে, আর রয়টার্সের নিউজ ট্রেসার সামাজিক মাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ শনাক্ত করে। এতে খবর তৈরির গতি যেমন বেড়েছে, তেমনি সাংবাদিকরা গভীরতর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে সময় দিতে পারছেন।

বাংলাদেশেও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো পাঠকের আচরণ বিশ্লেষণ করে পার্সোনালাইজড কনটেন্ট সাজাচ্ছে। অনেক মিডিয়া ভিডিও নিউজ তৈরিতে এআই ভয়েস ব্যবহার করছে, যা কম খরচে দ্রুত প্রোডাকশন সম্ভব করছে। সাংবাদিকতায় এটি সময় ও ব্যয়ের সাশ্রয় ঘটাচ্ছে যা ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।

তবে সব সুবিধার পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে এআই-এর নৈতিকতা নিয়ে। দ্য গার্ডিয়ান-এর কলামিস্ট পল চ্যাডউইক সতর্ক করে বলেছেন, পাঠক জানতেই পারে না, সংবাদটি মানুষ লিখেছে নাকি মেশিন। এতে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হয়। একইভাবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম সম্প্রতি বলেন, ভুয়া তথ্যের বিস্তার এখন ভয়াবহ। এআই যদি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যবহৃত হয়, তবে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।

২০২৪ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, শুধু ছয় মাসে ভুয়া সংবাদ ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা আগের বছরের তুলনায় ৩০% বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর বড় একটি অংশ এআই-চালিত ফেক ইমেজ ও ভিডিও।

এআই সাংবাদিকতায় যে সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি করেছে, তা হলো চাকরি সংকট। ২০২৩ সালে জার্মানির এক্সেল স্প্রিংগার গ্রুপ বিল্ড ও দায়ে ওয়েল্ট পত্রিকায় শত শত কর্মী ছাঁটাই করেছে। কারণ অনেক কাজই এখন এআই দিয়ে সম্ভব। অর্থনীতি বিষয়ক রিপোর্ট, খেলার ফলাফল কিংবা আবহাওয়ার খবরের মতো রুটিন কনটেন্ট ক্রমেই মেশিনের হাতে চলে যাচ্ছে।

তবে পেনা-ফের্নান্দেজ এট আল (২০২৫) তাদের গবেষণায় বলেছেন, এআই সাংবাদিকের মূল ভূমিকা কেড়ে নিতে পারবে না। কারণ সাংবাদিক কেবল সংবাদদাতা নয়, তিনি বিশ্লেষক, ব্যাখ্যাকারী এবং সামাজিক বিবেকের প্রতিফলন। অর্থাৎ এআই সাংবাদিকতার সহায়ক হবে, প্রতিস্থাপক নয়।

বাংলাদেশে এআই সাংবাদিকতার ব্যবহার এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। বড় মিডিয়া হাউসগুলো নিউজ এডিটিং, ভিডিও সাবটাইটেলিং এবং কনটেন্ট অ্যানালিটিকসে এআই ব্যবহার করছে। তবে এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ হলো নীতিমালার অভাব। কোন কাজ মেশিন করবে, আর কোন কাজ সাংবাদিক করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল হক বলেন, এআই আমাদের কাজে সহায়তা করতে পারে, তবে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ জরুরি। নইলে প্রযুক্তি হবে নিয়ন্ত্রক, সাংবাদিক হবে কেবল যন্ত্রচালক।

সব মিলিয়ে সাংবাদিকতায় এআই এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। যেমন একসময় ইন্টারনেট ছাড়া সংবাদকক্ষ অচল ছিল, ভবিষ্যতে এআই-ও হবে অপরিহার্য। তবে পার্থক্য হলো, এআই ব্যবহারে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও মানবিক তত্ত্বাবধান অপরিহার্য। সংবাদকে মানবিক করা, পাঠকের আস্থা ধরে রাখা এবং সত্যকে সত্য হিসেবে তুলে ধরা এ দায়িত্ব কেবল সাংবাদিকের হাতেই থাকবে। তাই বলা যায়, সাংবাদিকতায় এআই একদিকে বিপ্লব, অন্যদিকে সম্ভাব্য বিপদ। আর এ বিপদ কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় হলো সচেতন, প্রশিক্ষিত এবং দায়বদ্ধ সাংবাদিকতার চর্চা।

 

খাইরুল ইসলাম আল আমিন

সাংগঠনিক সম্পাদক

বাংলাদেশ অনলাইন সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদ (বনেক)

Link copied!